মানবতাবিরোধী অভিযোগের মামলায় আটক জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের-২ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানিকালে আবদুর রাজ্জাক এ দাবি ও নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন।
পরে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের শুনানি বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেন।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারে থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত একসঙ্গে কাজ করেছে ও একাধিক বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মুজাহিদ। কিন্তু আজ রাজনৈতিকভাবে বিপক্ষ দল হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ট্রাইব্যুনালের কাছে অতিরিক্ত একজন সাক্ষী ও নতুন একটি অভিযোগ গঠনের আবেদন জানালে ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন।
মামলা থেকে মুজাহিদের অব্যাহতি চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৪ মে আসামিপক্ষ লিখিত বক্তব্য পেশ করেছে। ওই দিন তার আইনজীবী নজরুল ইসলাম বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। মঙ্গলবার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক মুজাহিদকে এ আবেদনের বিষয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এর আগে অভিযোগ গঠনের পক্ষে গত ২১ মে পর্যন্ত শুনানিকালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কার্যক্রমকে উস্কে দেওয়ার সুনির্দিস্ট অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন।
প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উপস্থাপনসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও যুক্তি উপস্থাপন করে মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন পেশ করা হয়।
তিনি বলেন, মুজাহিদ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শহিদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত। মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, বদিউল আলমসহ ৫ জনকে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল থেকে ধরে নিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, বৈদ্যেরডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালুডাঙ্গি এলাকার ৩৯ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে ২১ জনের নাম-ঠিকানা ও পিতার নাম পাওয়া গেছে।
প্রসিকিউটর বাদল বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদ মুক্তিকামী জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের চর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর যুবকদেরকে ইসলাম রক্ষায় সর্বশক্তি ও প্রয়োজনে ভারতের সীমান্তে গিয়ে ইসলাম এবং শান্তি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুজাহিদ।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে একই বছরের ২ আগস্ট এ ৫ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ১৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-১ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ২৬ জানুয়ারি এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
এতে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরে সাধারণ মানুষকে হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে মুজাহিদের বিরুদ্ধে ১০৯ পৃষ্ঠার ৩৪টি অভিযোগ করা হয়।
প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন।
স্থানান্তরের আগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ অভিযোগ গঠনের আসামিপক্ষের শুনানি সম্পন্ন হলেও মামলা স্থানান্তরের কারণে নতুন করে শুনানি নিচ্ছেন ট্রাইব্যুনাল-২।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করার পর এ পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান ৫ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির ২ নেতাসহ মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদের মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সাঈদী ও সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণও চলছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি নেতা আবদুল আলীম শর্তসাপেক্ষে জামিনে থাকলেও অন্যরা কারাগারে আটক আছেন।
এছাড়া ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকার। প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে ট্রাইব্যুনালে।