ওয়েস্টার্ন মেরিনের এমডি জাহাজ নির্মাণশিল্পে সহজ শর্তে ঋণ প্রয়োজন

ওয়েস্টার্ন মেরিনের এমডি জাহাজ নির্মাণশিল্পে সহজ শর্তে ঋণ প্রয়োজন

বিকাশমান খাত হিসেবে জাহাজ নির্মাণশিল্পকে এগিয়ে নিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া এবং এর সুদের হার কমানো উচিৎ বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাখাওয়াত হোসেন।

এক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকেরও এগিয়ে আসা উচিৎ এবং আসন্ন বাজেটে সরকার এসব বিষয়ের ওপর নজর দেবে বলে আশা করছেন তিনি।

তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের জাহাজ নির্মাণশিল্প এগিয়ে নিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে এক অংকে নামিয়ে এনেছে। আর আমাদের দেশে এখনো ব্যাংক ঋণের সুদ প্রায় ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। ব্যাংক ঋণের এ উচ্চ সুদের হার জাহাজ নির্মাণশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়।’

আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে চট্টগ্রামে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ‘জাহাজ ভাঙার দেশ’ থেকে ‘জাহাজ নির্মাণের দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এনে দেওয়া মো. সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) কিংবা কৃষি খাতে যেভাবে সরকার কম সুদে ঋণ দিয়ে থাকে, তেমনিভাবে জাহাজ নির্মাণশিল্পে ঋণ দিলে আরও দ্রুত এই শিল্প বিকশিত হবে।

এছাড়া সরকার যদি এই শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ (প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিং) করে, সে ক্ষেত্রেও এই শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন।

‘ব্যাংকগুলো সহজভাবে ঋণ দিতে এগিয়ে আসলে এ শিল্প খুব দ্রুত প্রসার লাভ করবে’, যোগ করেন তিনি।

সাক্ষাৎকারে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের পাশাপাশি ব্যাংক গ্যারান্টির সমস্যা এবং শুল্ক আদায়ে বৈষম্যও আছে বলে মনে করছেন তিনি।

মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা রয়েছে। এই খাত থেকে প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব পায় সরকার। কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার ও কাঁচামালে গড়ে ৩৫ শতাংশ শুল্কহার জাহাজ নির্মাণশিল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।’

ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জাহাজ নির্মাণশিল্পের জন্য ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করে তাহলে নির্মাণ ব্যয় কমে যাবে। এছাড়া এ শিল্পে রয়েছে দ্বৈত কর কর্তন ব্যবস্থা। সরকার এই সেক্টরকে সম্ভাবনাময় শিল্প (থ্রাস্ট সেক্টর) ঘোষণা করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে দশমিক ৫ শতাংশ কর আদায় করার পরও আয়কর বিভাগ বছর শেষে কোম্পানির কাছ থেকে আবারও কর আদায় করে।’

তিনি মনে করেন, জাহাজ নির্মাণশিল্প এ দেশের নতুন শিল্প হওয়ায় এর উন্নয়নে কী করণীয় তা নির্ধারণ করা উচিত। জাহাজ নির্মাণশিল্পের জন্য নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

জাহাজ নির্মাণের শুরুর বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মেরিন একাডেমীতে পড়ার সময়েই মাথায় চিন্তা আসে জাহাজ নির্মাণের। এরপর ইংল্যান্ড থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে যোগদান করি। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করতে গিয়ে দেখলাম বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ পরিচিত গরিব দেশ হিসেবে। কিন্তু কেন? বাংলাদেশে কিসের অভাব? এ দেশে প্রচুর জনবল আছে, আছে বিশাল সমুদ্র ও নদী, শিল্প স্থাপন করার মতো জায়গাও রয়েছে। তবু কিসের যেন অভাব।

তিনি জানান, সাগর যেমন বড়, জাহাজ তৈরিও তেমনি বিশাল ব্যাপার। একটি জাহাজ নির্মাণের সঙ্গে কমবেশি এক হাজারেরও বেশি পরিবার পরোক্ষভাবে জড়িত। আল্লাহ-তায়ালা সাগরে সব ধরনের সম্পদ দিয়েছেন। ওখান থেকে আমাদের আহরণ করতে হবে। এই চিন্তা ও অভিপ্রায় থেকেই আমরা পাঁচজন মেরিনার আমাদের প্রফেশনাল ব্যবসা শুরু করি। ওয়েস্টার্ন মেরিন সার্ভিসেস নামে একটি ছোট প্রতিষ্ঠান দিয়ে যাত্রা শুরু।

‘দেখলাম চট্টগ্রামে ভালো কোনো ওয়ার্কশপ নেই, আমরা বন্দরে গেলাম সেখানে বিভিন্ন জাহাজের খোঁজ খবর নিয়ে সেসবের মেরামতসহ নানা কাজ দিয়ে শুরু করলাম। সেটা ১৯৯৪ সাল। তখন বন্দরে জাহাজের লিভ টাইম ছিল ৫-৭ দিন। সে সময়ে আমাদের কাজের সুযোগ তৈরি হলো, সার্ভিস দিতে দিতে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়লো। সে অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আমরা ২০০০ সালে ব্যবসার পরিধি বাড়ালাম।’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমরা কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সর্ম্পকে মনোযোগী হলাম এবং জাহাজ নির্মাণের পদ্ধতিগত জ্ঞান অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করলাম। খবর নিয়ে দেখলাম বাংলাদেশে কালীগঞ্জের দিকে জাহাজ বানায়, নারায়ণগঞ্জে বানায়, তাদের অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। আমরা এসব সমন্বয় করলাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে লোক আনলাম। প্রথমে ছোট ছোট জাহাজ বানাতে শুরু করলাম।’

‘জার্মানি থেকে আমরা একটা অর্ডার পেলাম। তারা চাইলো ১০০ মিটার লম্বা জাহাজ। বড় জাহাজ তৈরি করতে গেলে বড় জায়গা লাগবে। এক একর জায়গা দিয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিনের যাত্রা শুরু, আজ আমাদের ইয়ার্ডের পরিমাণ প্রায় ৪১ একর। এখন আমরা বছরে ১২টি বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণ করতে সক্ষম। যার একেকটির খরচ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ২০০ লোক দিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানে আজ পাঁচ হাজার লোক কাজ করে, যাদের উপর নির্ভরশীল ৫০ হাজার মানুষ। এছাড়া ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠান,  ব্যবসায়ী নানাভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।’

তিনি বলেন, ‘এ শিপইয়ার্ডের যাত্রা খুব বেশি দিনের না হলেও ইতিমধ্যে প্রথম বাংলাদেশি শিপইয়ার্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি আইএসও ৯০০১ : ২০০৮ সনদ লাভ করেছে। করপোরেট ম্যানেজমেন্ট, কোয়ালিটি এবং সময়মতো হস্তান্তরের কারণে অল্প সময়ে ওয়েস্টার্ন মেরিন সাফল্যের শীর্ষে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে এখন ছোট-বড় শতাধিক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ রপ্তানি করতে পারছে। সরকার এখন এই শিল্প থেকে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় করছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পজোন গড়ে তোলা হলে এই শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা বৈদেশিক মুদ্রা যেমন আয় করছি তেমন সাশ্রয়ও করছি। নতুন জাহাজ নদীতে নামিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায়ও অবদান রাখছি। বাংলাদেশে আরও ব্যবসায়ী যদি এ পেশায় এগিয়ে আসে তাহলে অর্থনৈতিকভাবে এ দেশ লাভবান হবে। রিজার্ভের পরিমাণও বাড়বে, মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।’

অর্থ বাণিজ্য