ক্যাসিনোবিরোধী চলমান অভিযানে গতকাল রবিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মোহামেডান ক্লাব ঘিরে ফেলে পুলিশ। এ অবস্থায় ক্লাবে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল বোর্ডরুম। ক্লাবটির উন্নয়নে মিটিং করার জন্য নির্ধারিত এ কক্ষে জুয়ার আসর যে বসত তা স্পষ্ট। কক্ষজুড়ে জুয়ার সামগ্রী। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের কোথাও তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি খেলার কোনো সামগ্রী। দামি সোফা, কারুকার্যখচিত বড় বড় ক্যাসিনো টেবিলে এলোমেলোভাবে রাখা ছিল জুয়ার বোর্ড, মদের বোতলসহ বিভিন্ন বাহারি আহারসামগ্রী। দেয়ালে টানানো টিভি।
গতকাল রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত মোহামেডানসহ চারটি ক্লাবে একযোগে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। অন্য তিনটি ক্লাব হচ্ছে ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ ও দিলকুশা। সব ক্লাবেই ঢুকে একই চিত্র চোখে পড়ে। ক্লাবগুলো থেকে ক্যাসিনো তথা জুয়ার বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। অভিযানের সময় সঙ্গে ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
অভিযানে মোহামেডান ক্লাব থেকে দুটি রুলেট টেবিল, ৯টি বোর্ড, বিপুল পরিমাণ কার্ড, ১১টি ওয়্যারলেস সেট ও ১০টি বিভিন্ন ধরনের চাকুসহ বিপুল পরিমাণ জুয়ার সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে একটি বড় টেবিল, বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার ৯টি বোর্ড, চেয়ার, সোফা, ক্যাসিনো কয়েন, বোর্ডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম, এক লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ তাস, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ জব্দ করা হয়েছে। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেটসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ।
অভিযানের সময় ক্লাবটির কোনো কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্লাবের ভেতরেই হাতের বাঁ পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে একটি সুসজ্জিত কক্ষ। সেখানে নতুন একটি ক্যাসিনো বোর্ড। এর চারপাশে দামি সোফা। কক্ষটির ওপরের দেয়ালে ঝুলছিল দামি বাতি। এর পাশের কক্ষে ঢুকেও পাওয়া গেল ক্যাসিনো বোর্ডসহ জুয়ার সরঞ্জাম। সেখান থেকে ক্যাশ কাউন্টারে ঢুকে দেখা যায়, তাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। চেয়ার-টেবিল সব এলোমেলো। এর পাশেই রয়েছে একটি স্টোর রুম।
এখানেও মদের বোতলসহ বিভিন্ন ক্যাসিনো সরঞ্জাম। ওয়াশরুমগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে জুয়ার কড়ি। এরপর চোখে পড়ে একটি গোপন কক্ষ। সেখানেও জুয়ার সরঞ্জাম। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুখে চোখে পড়ে টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো তাস। পাশাপাশি রয়েছে খোলা তাসের প্যাকেট ও তাসের অসংখ্য বান্ডেল এবং তার পাশেই একটি মদের বোতল। তার পাশের অন্য একটি টেবিলে রয়েছে ক্যাসিনোর কয়েন।
এদিকে মতিঝিলে প্রথম দফায় অভিযানের সময় বিদেশী জুয়ারীদের পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে। ওই এলাকায় নেপালের নাগরিকসহ ১৯জন বিদেশী জুয়ারী ছিলেন, যারা অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়িয়ে সটকে পড়েছিল।
গতকালের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্লাবগুলো থেকে টাকা, মদ, সিসা, ক্যাসিনো ও জুয়ার সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। চারটি ক্লাবেই ক্যাসিনো ও জুয়ার সামগ্রী পাওয়া গেছে।’
এত দিন কেন অভিযান চালানো হয়নি—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগেও এ এলাকার কয়েকটি বহুতল ভবনে ক্যাসিনো বারে অভিযান চালিয়ে সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছিল। তবে এর আগে আমাদের কাছে ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো সরঞ্জামের বিষয়ে কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এত বড় পরিসরে হয়নি।’ মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক বলেন, ক্যাসিনোর ব্যাপারে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে আগে জানিয়েছেন।
ক্লাবের আশপাশের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেলে ক্লাবপাড়ায় অভিযান চালানো হবে বলে খবর আগেই ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাবের হোতারা পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যায়।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে র্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে র্যাবের আকস্মিক অভিযানের পর থেকেই আরামবাগ, দিলকুশা, ভিক্টোরিয়া ও মোহামেডান ক্লাবের ক্যাসিনো ছিল বন্ধ। গতকালও পুলিশ বন্ধ ক্যাসিনোর তালা ভেঙে সেখান থেকে সরঞ্জাম জব্দ করে। ওই এলাকায় ৯ জন নেপালের বড় জুয়াড়িসহ ১৯ জন বিদেশি জুয়াড়ির তথ্য মিলেছে। এরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। অথচ এরা ক্লাবের আশপাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত। অভিযানের সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের বাসায় গিয়ে খবর জানিয়ে পালাতে সাহায্য করে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এমনই তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। গোপন খবর দিয়ে ওই পুলিশ সদস্যরা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলেও জানিয়েছে সূত্র। কয়েকজনকে ব্যাগ হাতে বাসা থেকে বের হতে দেখা গেছে। এসব পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।