এক সময় ঢাকায় ফুটবল লিগের দাপুটে দল ছিলো ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। পরে স্বাধীনতার পর আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের মধ্যেও বহুদিন ধরে উজ্জ্বল ছিলো আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স, এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো দলগুলো।
ফুটবলের পাশাপাশি অনেকগুলো দলেরই ক্রিকেট ও হকি দলও ছিলো যেখানে বিশ্বের নামী দামী অনেক খেলোয়াড়ও খেলে গেছেন।
ফুটবলের সেই জৌলুস এখন আর নেই, এমনকি ক্রিকেট ভালো করলেও এসব দলগুলোর অনেকগুলোই আর তাতে নেই। নেই তারা হকিতেও।
এমনকি যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তৈরি হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র সেই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে জুয়ার আয়োজন করা।
বুধবার রাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে দেখা গেছে স্পোর্টস বাদ দিয়ে ক্লাবগুলো মজে আছে জুয়ার এমন আয়োজনে যার আধুনিক নাম ক্যাসিনো।
ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণের ভূমিকাতেও আর খেলোয়াড় কিংবা সংগঠকরা নেই, আছেন সরকারদলীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ আসছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেই।
ক্রীড়া থেকে জুয়া হয়ে ক্যাসিনো: ক্লাবের রংবদল
কবে কীভাবে ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলা বিদায় নিয়ে নিষিদ্ধ ব্যবসা চালু হলো তা নিয়ে নানা ধরণের মত পাওয়া যায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন এসব ক্লাবে দীর্ঘকাল ধরেই জুয়ার চর্চা ছিলো, কিন্তু অনুমোদনহীন ক্যাসিনো কিভাবে হলো তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়না তেমন একটা।
তবে ক্লাবগুলোর সাথে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে জানা গেছে আবাহনী মোহামেডানসহ অন্য প্রায় সব ক্লাবেই জুয়ার প্রচলন ছিলো আশির দশক থেকেই এবং সেটি করা হতো মূলত ক্লাবের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য।
তখন ক্লাবের সংগঠকরা রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেননা বরং ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিলো, ফলে খেলাধুলাতেও ক্লাবগুলো বেশ ভালো করেছিলো।
“তখন মূলত ওয়ান-টেন নামে একটি জুয়া হতো। যেটি হাউজি নামেও পরিচিত ছিলো। সপ্তাহে কয়েকদিন হতো। ক্লাবের বার্ষিক দাতাদের বাইরের বড় আয় আসতো এই হাউজি থেকেই,” বলছিলেন ঢাকার একটি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।
জানা গেছে জুয়া হিসেবে তখন ক্লাবগুলোতে হাউজি, ওয়ান-টেন ও রামিসহ কিছু খেলা চালু ছিলো আর বোর্ড বা জায়গা ভাড়া দিয়ে অর্থ আয় হতো ক্লাবের।
ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর অনেকগুলোই ঘুরে দেখেছেন ব্যবসায়ী সুমন জাহিদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন ঢাকায় ক্লাবে ক্যাসিনো সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে কলাবাগান ক্লাবের হাত ধরে প্রায় ৭/৮ বছর আগে।
“এরপরই স্লট মেশিন, জুয়ার আন্তর্জাতিক মানের বিশেষ বোর্ড এগুলো আসতে শুরু করে ক্লাবগুলোতে। প্রথমে সব ক্লাবই বাকারা নামে একটি খেলা দিয়ে শুরু করে। পরে যোগ হয় রুলেট নামে আরেকটি খেলা”।
তবে এর ভিন্নমতও আছে। নিয়মিত ক্যাসিনোতে যান এমন একজন জানান মতিঝিলের ক্যাসিনোগুলোতে যাওয়ার আগে তিনি মালিবাগের সৈনিক ক্লাবের ক্যাসিনোতে গিয়ে খেলেছেন।
রং বেরংয়ের ক্যাসিনো: নগদ টাকার মেলা
বিদেশের মতো বিশাল বড় ফ্লোরে হাজার রকমের জুয়া খেলার যন্ত্রপাতির সমাহার না হলেও স্লট মেশিন কমবেশি সব ক্লাবে পৌঁছে গেছে গত ৫/৬ বছরে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক মুকুল চাকমা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তিনি সেগুনবাগিচা এলাকায় অবৈধ মাদক সেবনের খবর পেয়ে একটি অভিযান চালান বছর দুয়েক আগে এবং অভিযানে সেখানেই ক্যাসিনোর অস্তিত্ব পান।
পরে সেটি বন্ধও হয়ে যায় বলে জানান তিনি।
সেগুনবাগিচায় একটি বন্ধ হলেও পরবর্তীতে মতিঝিল, কলাবাগান, তেজগাঁও এবং এলিফ্যান্ট রোডে জমজমাট হয়ে উঠে কয়েকটি ক্যাসিনো।
তবে এর আগেই নগরীতে ক্যাসিনোর ধারণা কলাবাগান থেকে শুরু হলেও এর নির্ভরযোগ্য আরেকটি জায়গা হয়ে দাড়ায় তেজগাঁওয়ের ফুওয়াং ক্লাব।
মূলত তাইওয়ানিজদের একটি দল ২০০০ সালের দিকে এখানে পানশালা-কাম-রেস্তোঁরা চালু করে। পরে তাদের বিদায়ের পর বাংলাদেশী একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার হাত ধরে চালু হয় ক্যাসিনো।
এরমধ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মতিঝিলের ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ যায় যুবলীগের কয়েকজন নেতার হাতে।
তারাই মূলত ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন ক্যাসিনোকে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স ক্লাব – চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেও ।
কিন্তু অর্থের অভাবে দল গঠন করতে পারবেনা সেজন্য আগের স্তরেই থেকে যায়, অথচ সেই ক্লাবেই র্যাব অভিযান চালিয়ে সবচেয়ে বড় ক্যাসিনোর অস্তিত্ত্ব খুঁজে পেয়েছে বুধবার রাতে।
আবার নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী ও নিরাপত্তা কর্মীও নিয়ে আসে কয়েকটি ক্যাসিনো। যদিও জুয়া খেলা বলতে স্লট মেশিন, বাকারা আর রুলেটই প্রধানত এখানে খেলা হয়।
এখন র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন ঢাকায় অন্তত ৬০টি ক্যাসিনো আছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
মুকুল চাকমা বলছেন অনেকদিন ধরেই এসব বিষয়ে তথ্য আসছিলো কিন্তু এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার জন্য ব্যবস্থা নেয়াটা সহজ হয়েছে।
তিনি বলছেন এসব ক্যাসিনো হুট করে হয়নি এটি সত্যি এবং হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও তথ্য ছিলো। সে কারণেই এবারে একটি সফল অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন ক্যাসিনোগুলোর ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সমাজের সব স্তরের প্রভাবশালীরাই এসব ক্যাসিনো গড়ে তুলেছেন।
“যারা খেলতে গিয়েছে তাদের কেউ কেউ ধরা পড়েছে। কিন্তু এসব ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি আনার অনুমতি কে দিয়েছে। কারা বছরের পর বছর জেনেশুনেও এসব চলতে দিয়েছে। সুবিধা নিয়েছে নিয়মিত। সবাই মিলেই এসব তৈরি করেছে। ব্যবস্থা নিতে হলে এদের সবার বিরুদ্ধেই নিতে হবে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে”।
মতিঝিলের ক্যাসিনোগুলোতে নিয়মিত যান এমন একজন জানান, সেখানে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হয় এবং ২৪ ঘণ্টাই এগুলোতে সচল থাকে জুয়ার বোর্ড।
তিনি বলেন, “এক হাজার থেকে ১ লাখ টাকার কয়েন বা চিপস কিনে বসে। অনেকে সেখানেই অ্যালকোহল পান করেন। তবে এসব ক্যাসিনোতে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। ভেতরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেন আয়োজকরা। আর এসব আয়োজনের মধ্যেই প্রতিদিন সর্বস্বান্ত হয় অসংখ্য মানুষ”।
সামনে রাখা হয় বড় নেতাদের
ক্লাবগুলোর প্রায় সবগুলোতেই চেয়ারম্যান হিসেবে সামনে রাখে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা বড় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে। কিন্তু এসব নেতারা সেসব ক্লাবে যাওয়ারও সুযোগ পাননা তেমন একটা।
একটি ক্লাবের সাথে জড়িত একজন কমকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে জানান, মূলত মতিঝিল এলাকার একজন কাউন্সিলর ও র্যাবের অভিযানে আটক হওয়া যুবলীগ নেতাই সবগুলো ক্লাবের নিয়ন্ত্রক।
এর মধ্যে কাউন্সিলর দুটি ক্লাব সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। আর বাকীগুলো ছিলো র্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতার হাতে।
আবার তাদের দুজনকেই নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগেরর একজন নেতা, যাকে নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেও বক্তব্য রেখেছেন বলে ঢাকার পত্রিকায় খবর এসেছে।
কিন্তু তারা ক্লাবগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মূলত ক্যাসিনো গড়ে তুললেও ক্লাব কর্মকর্তারা রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই এসব নিয়ে মুখ খুলতে পারেননি।
আবার কোনো কোনো ক্লাবের কর্মকর্তারাও ব্যাপক অর্থের লোভে জড়িয়ে গেছেন এই অবৈধ ব্যবসায়। কারণ অবৈধ হলেও এসব ক্যাসিনো মালিকদের কাছ থেকে সুবিধা নিতো সব পেশার লোকজনই।
ওই কর্মকর্তা বলছেন থানাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রায় সব বাহিনীর লোকজনই এসব জানতো কিন্তু কেনো এতোদিন কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সেটাই বিস্ময়ের বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। বিবিসি