সারা দেশের নদ-নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে এক বছরের ক্রাশ প্রগ্রাম (উচ্ছেদ কার্যক্রম) হাতে নিয়েছে সরকার। এ জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমের আওতায় নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের পাশাপাশি নদীর জমি কারো নামে লিজ দেওয়া হয়ে থাকলে কিংবা কারো মালিকানায় থাকলে তা বাতিল করা হবে। নদীর জমি ভুলক্রমে কিংবা অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়ে থাকলে তা বাতিল হবে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হবে। মরা নদীর জমি চিহ্নিত করার জন্য জরিপ পরিচালনা করা হবে। মরা নদীর জমি সংরক্ষণ করা হবে।
একই সঙ্গে সরকারের ১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে সারা দেশের নদ-নদী, খাল ও জলাশয় দখল ও দূষণমুক্তকরণ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য আটটি বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এরই মধ্যে সারা দেশের জেলাভিত্তিক নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশও করা হয়েছে। দেশের ৬১ জেলায় ৪৬ হাজার ৭৪২ জন দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড়—এই তিন জেলা প্রশাসন এখনো নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা জমা দেয়নি। তাদের আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তালিকা তৈরি করে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারের সচিব ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের নদ-নদী রক্ষার একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সারা দেশের নদ-নদীকে দখলমুক্ত করার জন্য এর আগে তৈরি করা অবৈধ দখলদারদের তালিকা ধরে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বছর মেয়াদি ক্রাশ প্রগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনি এই কার্যক্রমে দেশবাসীর সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে গত ২৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে ক্রাশ প্রগ্রাম পরিচালনার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। তালিকা অনুসারে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার করা নদ-নদী ও তীরভূমি, ফোরশোর যাতে পুনঃ দখল না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন/উপজেলা ভূমি অফিসের নিয়মিত পরিদর্শন ও নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ নিতেও বলা হয়েছে।
নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মইন উল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা এই নির্দেশনা পেয়েছেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক আতাউল গণি জানিয়েছেন, নদী দখলমুক্ত করার জন্য এরই মধ্যে অবৈধ দখলদারদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে, খননকাজ শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তার আগেই নদী দখলমুক্ত হবে।
নদ-নদী রক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুসারে জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জেলা প্রশাসক ও কালেক্টররা কী কী আইন প্রয়োগ করতে পারবেন তা-ও নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। নদ-নদী রক্ষায় হাইকোর্টের ১৩৯৮৯/২০১৬ নম্বর রিট পিটিশনের আদেশও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নদীর জমি কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা থাকলে তা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের। একইভাবে জমি কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়ে থাকলেও তা বাতিল ও সংশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের। এই প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জারি করা একটি পরিপত্রও যুক্ত করা হয়েছে। নদ-নদীর দখল উদ্ধারে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট বিধি- ১৩৩, ১৩৯(ক) ধারায় নদী, খাল ও পথ/স্থানের গণ-উৎপাত বা উপদ্রব অপসারণের আদেশ প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দণ্ডবিধির অধীনেও (ধারা ২৭৭, ২৭৮, ২৮১-২৮৩) অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানান, মরা নদী ও খালের জমিও সরকারের অনুকূলে থাকবে। এগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য বিদ্যমান আইন অনুসারে কালেক্টর কিংবা রাজস্ব কর্মকর্তা দিয়ারা জরিপ ম্যাপ (আরএস কিংবা চর্চা ম্যাপের আইনানুগ ভিত্তি/গ্রহণযোগ্যতা এ ক্ষেত্রে নেই) প্রস্তুত করবেন। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) স্যাটেলাইট সার্ভের মাধ্যমে দেশে নদ-নদীগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান নির্ধারণ এবং এসংক্রান্ত ডিজিটাল ডাটাবেইস তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরকারের ১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে নদ-নদী, খাল ও জলাশয় দখল ও দূষণমুক্তকরণ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরির জন্য যে বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের একজন সদস্যকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জেলা পরিষদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্পারসো, বন বিভাগ, সিটি করপোরেশন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
কমিটিকে নদ-নদী, খাল ও জলাশয় অবৈধভাবে দখল ও দূষণমুক্ত করা ও উন্নয়নের জন্য ক্রাশ, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছে। কমিটিকে মাসে কমপক্ষে একবার বসে আগামী ছয় মাসের মধ্যে খসড়া কমিশনে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাজধানীর আশপাশের চার নদী নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন চলছে অবৈধ দখল উচ্ছেদের কার্যক্রম। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, ভূমি রক্ষা ও ব্যবহারের জন্য দু-তিন বছরের স্বল্প, তিন-পাঁচ বছরের মধ্য এবং ৫-১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।