শেয়ারবাজারে  আবার বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে

শেয়ারবাজারে আবার বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে

শেয়ারবাজারে গতকাল বুধবার আবার বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। ফলে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২০১৬ সালের অবস্থানে ফিরে গেছে। এক দিনেই সূচকটি ৭৬ পয়েন্ট বা দেড় শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৯৩৩ পয়েন্টে। গত প্রায় ৩৩ মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স সূচকটি ৪ হাজার ৯২৪ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি কাল ২১৪ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৪০ শতাংশ কমেছে।

বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে তারল্যসংকট চলছে। কমে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ। একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক মাসে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে কেবলই লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম আর বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের সহযোগী এক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গত এক মাসে প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজেদের শতকোটি টাকার পত্রকোষ (পোর্টফোলিও) বিনিয়োগের বিপরীতে প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। লোকসানের বড় অংশই হয়েছে গ্রামীণফোনের শেয়ারের বিপরীতে।

বর্তমান বাজারে বড় ধরনের দরপতনের জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, কারসাজি, মানহীন কোম্পানির আইপিও, সুশাসনের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্টদের দ্বন্দ্বকে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, বাজারের বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এর অংশ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবিতে মতিঝিলে মানববন্ধনও করা হয়। সম্প্রতি বিএসইসির নির্দেশে আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে ক্ষোভ আরও বেড়েছে।

বিএসইসির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে কমিটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২২ আগস্ট এ খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর ওই দিন সূচক বাড়ে। কিন্তু ২৮ আগস্ট বিএসইসি দাবি করে যে দুদকের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর থেকে আবারও সূচকের পতন শুরু হয়। যদিও দুদকের পক্ষ থেকে এই তদন্তের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

জুনে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকে বাজারে টানা দরপতন চলছে। ফলে জুলাইয়ে ডিএসইএক্স সূচকটি কমে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসে। এর কারণ অনুসন্ধানে বিএসইসির গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন বাজেট ঘোষণার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর ১ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ৭ কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ৯ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।

টানা পতনে বাজারে যখন লেনদেনে খরা চলছে, তখন মানহীন কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে বিপুল অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দিয়ে চলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর ফলে সেকেন্ডারি বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা।

তিন বছরে সর্বনিম্ন সূচক
বাজেট ঘোষণার পর থেকে বাজারে টানা দরপতন
এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড়

জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, নতুন আইপিও শেয়ারের আবেদনের জন্যও অনেক বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে সেকেন্ডারি বাজার থেকে কোনো মুনাফা করতে পারছিলেন না তাঁরা। এ কারণে লাভের আশায় বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ আইপিও শেয়ারের দিকে ঝুঁকছে। তিনি বলেন, বাজারে তারল্যসংকট, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন, গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির পাওনা নিয়ে দ্বন্দ্বও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

গ্রামীণফোনে বেশি লোকসান

পাওনা আদায় নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সঙ্গে দ্বন্দ্বে গত প্রায় সাড়ে চার মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে ১১২ টাকা। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার পাওনা দাবি পরিশোধের জন্য বিটিআরসি কোম্পানিটিকে প্রথম চিঠি দেয় ২ এপ্রিল। এরপর থেকে বাজারে এর শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে। ১ এপ্রিল ডিএসইতে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ছিল ৪১৭ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা কমে নেমে এসেছে ৩০৫ টাকায়। এ কোম্পানির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগ বেশি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোনের দরপতনের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। মাসের পর মাস পাওনা আদায়ে বিটিআরসির সঙ্গে গ্রামীণফোনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি জিইয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা।

বিএসইসির সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্টদের দ্বন্দ্ব

সাম্প্রতিক সময়ে মানহীন বেশ কয়েকটি কোম্পানির আইপিও এবং তালিকাভুক্তি নিয়ে ডিএসইর সঙ্গে বিএসইসির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। আর্থিক প্রতিবেদনে নানা অসংগতির কারণে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ। এরপর কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত করতে বিভিন্ন মহল থেকে ডিএসইর ওপর চাপ তৈরি করা হয়। একপর্যায়ে বিএসইসির নির্দেশে কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিতে বাধ্য হয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ডিএসইর পর্ষদের সিদ্ধান্তের পরও সংস্থাটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানকে পুনর্নিয়োগ দেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এসব ঘটনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ডিএসইর বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

এর বাইরে বিএসইসি সাম্প্রতিক সময়ে যেসব মানহীন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন করেছে, তা নিয়েও মতবিরোধ আছে ডিএসইর। বিএসইসির সঙ্গে একাধিক বৈঠকে ডিএসইর পক্ষ থেকে মানহীন কোম্পানির আইপিও প্রসঙ্গ তোলা হলেও বিএসইসির পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতেও অপারগতা জানানো হয়। এসব নিয়ে ভেতরে-ভেতরে দুই সংস্থার দ্বন্দ্ব কেবল বেড়েই চলেছে।

বাজার পরিস্থিতি

ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন হওয়া ৩৫৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৮৮টি বা ৮২ শতাংশেরই দরপতন ঘটেছে। দাম বেড়েছে মাত্র ৩৭টি বা ১০ শতাংশের। বড় ধরনের দরপতনের মধ্যে গতকাল লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। দিন শেষে ঢাকার বাজারে লেনদেন হয় ৫০২ কোটি টাকার, যা আগের দিনের চেয়ে ৯৫ কোটি টাকা বেশি। দরপতনের বাজারেও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে নিম্নমানের স্বল্প মূলধনি কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজি ছাড়া এসব শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। ঢাকার বাজারে গতকাল মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ন্যাশনাল টিউবস। সাড়ে ৩১ কোটি টাকার মূলধনের এ কোম্পানির শেয়ারের দাম গত চার দিনে ৩২ টাকা বা সাড়ে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আর ২ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানি মুন্নু জুট স্টাফলারের শেয়ারের দাম ১১ দিনে বেড়েছে ৭১১ টাকা বা ৫৪ শতাংশ। সাড়ে ৬ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের দাম এক মাসে ১১৩ টাকা বা ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। ৫ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানি স্টাইল ক্র্যাফটের দাম ১১ কার্যদিবসে ১৯৯ টাকা বা ২৮ শতাংশ বেড়েছে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়লেও এসব কোম্পানির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে বাজারে বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থার সংকট বিরাজ করছে। বাজারে সুশাসনের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। কারসাজির ঘটনাও ঘটছে। আবার একের পর এক মানহীন কোম্পানি বাজারে আসছে। বছরের পর বছর এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করায় ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ খবর