চট্টগ্রামে এসেই বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। গত দুদিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না। ক্রাচে ভর দিয়েই অ্যান্ডি মোলস অনুশীলন করাচ্ছেন, উইকেট দেখছেন।
আফগানিস্তান দলের কোচকে দেখে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কিউরেটর জাহিদ রেজার মনে পড়ে বাংলাদেশ দলের প্রয়াত কোচ এডি বারলোকে, ‘‘মোলসের সঙ্গে এডি বারলোর অনেক মিল। বারলো যেভাবে আমাদের জাতীয় দল থেকে শুরু করে ক্রিকেটের ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করত, মোলস ঠিক একই কাজ করছে আফগানিস্তানে। জাতীয় দল, বয়সভিত্তিক কিংবা একাডেমি—সব দল ওর অধীনে। কদিন আগে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের বিপক্ষে যে আফগানরা সিরিজ জিতল, সেটিতে বড় অবদান কিন্তু এই মোলসের।’’
আফগান ব্যাটসম্যানদের ‘মাথা গরম’ বলে যে ‘সুনাম’ আছে সেটি বেশ বদলাতে পেরেছেন মোলস। বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে অহেতুক শট খেলার প্রবণতা কমিয়েছেন। চট্টগ্রামে কদিন আগে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের বিপক্ষে যে কটা ম্যাচে জিতেছে, প্রতিটিতে দেখা গেছে আফগান ব্যাটসম্যানরা বেশির ভাগ সময়েই সোজা ব্যাটে খেলেছেন। বল মাটিতে রাখার চেষ্টা করেছেন। ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। স্কিলে অনেক বদল এসেছে আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের—পাঁচ বছর ধরে আফগানিস্তান ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত মোলসের তৃপ্তি এটাই, ‘স্কিল নিয়ে অনেক কাজ করছি। বোঝানোর চেষ্টা করছি কোন সংস্করণে কীভাবে খেলতে হয়। টি-টোয়েন্টিতে আক্রমণাত্মক হতে হয়। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে পরিস্থিতি বুঝে রক্ষণাত্মক, কখনো আক্রমণাত্মক হতে হয়। আর বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে দায়িত্ব নিতে হয়। অনেক ধারাবাহিক হতে হয়। লম্বা জুটি গড়তে হয়।’
একটা নবীন টেস্ট-খেলুড়ে দেশের খেলোয়াড়দের মানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন আনা মোটেও সহজ নয়। মোলসের জন্য সহজ ছিল না আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চাকরিটা বেছে নেওয়াও। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ‘টেলিগ্রাফ’ তাঁকে নিয়ে একবার একটা প্রতিবেদন করেছিল এ শিরোনামে: ‘অ্যান্ডি মোলস ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর চাকরিটা করছেন।’ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আফগানদের ব্যাটিং কোচ হওয়ার প্রস্তাব পান ইংলিশ কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারের সাবেক এ ওপেনার, পরিবার কিংবা কাছের বন্ধুদের প্রশ্ন ছিল, ‘তুমি কি নিশ্চিত? এটা তো যুদ্ধ প্রবণ অঞ্চল।’
আফগানদের দুর্দান্ত লেগ স্পিনার পাওয়ার রহস্য
টেস্ট খেলছে ১৯ বছর হলো, এখনো একজন ভালো মানের লেগ স্পিনার পায়নি বাংলাদেশ। অথচ এ আফগানিস্তান দলেই আছে তিনজন রিস্ট স্পিনার। আফগানিস্তানের কোচ অ্যান্ডি মোলস জানালেন একাধিক রিস্ট স্পিনার পাওয়ার রহস্য, ‘আফগানিস্তানে এমন অনেক বোলার আছে। আমাদের সিস্টেমেই এখন ১০-১৫ জন রিস্ট স্পিনার বোলার আছে। সবাইকে মূল দলে জায়গা দিতে পারছি না, কিন্তু আমাদের আছে। চায়নাম্যানই (বাঁহাতি লেগ স্পিন) আছে তিন-চারজন। খুদে বোলাররা সবাই রশিদকে (খান) অনুকরণ করে। আফগানিস্তান জুড়েই এমন অসংখ্য বোলার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রশিদ স্পিন বোলারদের মধ্যে একটা প্যাশন তৈরি করেছে বিশেষ করে লেগ স্পিনে। খুদে ক্রিকেটাররা তার মতো হতে চায়। তারা তাদের আইডলকে কপি করতে চাই। বাংলাদেশে লেগ স্পিনার নেই কিন্তু ভালো বাঁহাতি স্পিনার আছে। সবাই বোধ হয় সাকিব (আল হাসান) হতে চায়। খুদে ক্রিকেটাররা আইডলকে কপি করতে চায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভালো ফাস্ট বোলার পেয়েছে এভাবেই।’
কোচিং তাঁর প্যাশন, তাঁর ভালোবাসা। ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ মন্ত্রেই মোলস আফগানিস্তানে কাটিয়ে দিলেন পাঁচটা বছর। আফগানিস্তানের কোচ হিসেবে কাজ করার সেই অভিজ্ঞতা বলছিলেন ৫৮ বছর বয়সী মোলস, ‘কাজটা এত কঠিন নয়। এটা দেখি উদীয়মান একটা দেশের চাকরি হিসেবে। শুরুতে যখন দুই সপ্তাহের জন্য ব্যাটিং পরামর্শক হয়ে সেখানে গেলাম, খেলোয়াড়দের প্যাশন আমাকে মুগ্ধ করল। তবে পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন ছিল খুবই। এখানে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড অনেক সহায়তা করেছে। বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান নিরাপত্তাবাহিনী থেকে এসেছেন বলে তিনি নিরাপত্তার ব্যাপারটা খুব ভালো জানেন। তবে হ্যাঁ, যদি বাইরে যে সমস্যা আছে, তাতে অনেক ঝুঁকি আছে। আপনাকে সেটি সামলে চলতে হবে।’
কাজের সূত্রে বছরের তিন থেকে চার মাস তাঁকে থাকতে হয় কাবুলে। এ সময়ে তিনি থাকেন হোটেলে। আট-দশজন নিরাপত্তাবাহিনী সদস্য তাঁকে জিপে করে মাঠে নিয়ে যান, আবার হোটেলে নিয়ে আসেন। এত নিরাপত্তার মধ্যেও কাবুল মাঝেমধ্যে কেঁপে ওঠে বোমার শব্দে। কেঁদে ওঠে রক্তাক্ত মানুষের আর্তনাদে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের বাতাসে বারুদের গন্ধ, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর তালেবানি হুমকি তো আছেই। একজন সাবেক ইংলিশ ব্যাটসম্যান, একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করেছেন নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া, স্কটল্যান্ড ও হংকংয়ের হয়ে—চাইলে তো এই ঝুঁকির চাকরি এড়িয়েও যেতে পারতেন।
কেন এড়িয়ে যাননি, সেটি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিলেন মোলস, ‘সত্যি বলতে কী আপনি যখন সেখানে থাকবেন শুধু সংবাদমাধ্যমেই বোমা বিস্ফোরণের খবর পাবেন। আফগানিস্তানে প্রতিদিন বোমা বিস্ফোরণ হয় না। গত পাঁচ বছর ধরে তো সেখানে আছি, নিজ চোখে কখনো এমন ঘটনা দেখিনি। তবে আপনারা দেখছেন প্রতি মাসে সেখানে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকলেই শুধু এটা দেখতে পাবেন। তবে একটা জিনিস বলতে পারি, আফগানিস্তানের মানুষ ক্রিকেটকে অনেক ভালোবাসে, ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টদের অনেক সম্মান করে। এমনকি তালেবানরাও ক্রিকেট অনেক পছন্দ করে। তারা কখনো ক্রিকেট বা ক্রিকেট দলের ওপর আক্রমণ করবে না। তারা জানে একমাত্র ক্রিকেটেই তাদের সুখবর এনে দেয়।’
কোচকে নিয়ে কী বলেন রশিদ খান
আজ সংবাদ সম্মেলন শেষে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে আফগান অধিনায়ক রশিদ খান মোলসকে মূল্যায়ন করলেন এভাবে, ‘তিনি অনেক ভালো মানুষ। গত পাঁচ বছর ধরে আফগানিস্তানে আছে। তার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক ভালো। ভীষণ ইতিবাচক মানুষ, খেলোয়াড়দের অনেক সমর্থন করে। তার চাহিদাও সীমিত। যার যা লাগবে সে ভীষণ সহায়তা করে।’
মোলস আসলে কাজ করেন অনূর্ধ্ব-১৯, ২৩ ও ‘এ’ দল নিয়ে। আফগানদের পাইপলাইন সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। সেখানে তিনি বেশ সফল। কদিন পর পর যে দুর্দান্ত সব বোলার দেখা যায় আফগানিস্তান দল, সেটি তাঁর সিস্টেম থেকেই আসে। জাতীয় দলের কোচ না থাকলে তাঁকে দিয়ে আপৎকালীন দায়িত্বটাও সারে আফগানিস্তান। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে কবির খান বিদায় নিলে টুর্নামেন্টে আফগানদের কোচ ছিলেন মোলসই। ফিল সিমন্স চলে যাওয়ার পর এবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন একই দায়িত্ব নিয়ে।
আফগানরা প্রধান কোচ পেয়ে গেলে শেষে হয়ে যাবে তাঁর আফগানিস্তান-অধ্যায়। খুঁজতে হবে নতুন চাকরি। পেশাদার কোচ হিসেবে নতুন চাকরি, নতুন ঠিকানা হয়তো পেয়েও যাবেন। তবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তাঁর সময়টা যে কেটেছে বেশ, দুপুরের উজ্জ্বল আলোয় তাঁর উজ্জ্বল হাসিটাই বলে দেয় তা, ‘ভীষণ উপভোগ করেছি আফগানিস্তানের অধ্যায়। খেলাটা নিয়ে তাদের তুমুল আগ্রহ ভালো লাগে। শুধু খেলেই না, এটা নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলে, আলোচনা করে। নতুন আইডিয়া বের করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। এসবই মুগ্ধ করেছে আমাকে।’
অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, দাঁড়িয়ে কথা বলার উপায় ছিল না। ড্রেসিংরুমের সামনে বসেই কথা বললেন মোলস। এ অসুস্থতা নিয়ে মাঠে না এলেও চলত। তবুও এসেছেন। শুধু পেশাটার প্রতি গভীর নিবেদনই নয়, আফগানদের প্রতি তাঁর ভালোবাসাটাও যে কম নয়!