পিপিপিতে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

পিপিপিতে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।

এসময় তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যেভাবেই হোক আমরা পদ্মাসেতু করবো। বিশ^ব্যাংক পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির কথা বলেছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাদের কাজ করার দরকার নেই।

তিনি বলেন, পদ্মাসেতু তৈরির কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা বেসরকারিভাবে আহ্বান জানাবো। যে আসবে তাদের দেওয়া হবে। এতে আমাদের টাকা লাগবে না। বেসরকারিভাবে যারা সেতু নির্মাণ করবে তারা এটা পরিচালনা করে টাকা তুলে নিয়ে যাবে। এজন্য ২০, ৩০, ৪০ বা ৫০ বছর যা লাগে লাগুক।

বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির কথা বলেছে, কোথায়, কত টাকা দুর্নীতি হয়েছে তার প্রমাণ অবশ্যই তাদের দিতে হবে।

জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতু প্রসঙ্গে আরো বলেন, বেসরকারি খাতে পদ্মাসেতু তৈরির লক্ষ্যে আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি। এজন্য একটি সেলও গঠন করা হয়েছে। একজন সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া সফর উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে পদ্মাসেতু প্রসঙ্গ তুলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় উন্নয়নকাজ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বহু দেশ আছে বেসরকারিভাবে এ ধরনের ডেভেলপমেন্ট কাজ করে থাকে। জাপান, তুরস্ক, চীন, কোরিয়া, কাতারসহ অনেক দেশ বেসরকারিভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করে। পদ্মাসেতু তৈরির কাজ করার জন্য তাদের আহ্বান জানানো হয়েছে। আবারো আহ্বান জানাবো।

পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক টাকাই ছাড়েনি। আমার প্রশ্ন যেখানে টাকাই ছাড়া হলো না সেখানে দুর্নীতি হলো কীভাবে? টাকা না ছাড়লে তো দুর্নীতির তো প্রশ্ন আসে না। দুর্নীতি হলে তার তথ্য প্রমাণ দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের জানতে চেয়েছিলাম তারা কোনো তথ্য প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা বলেছে পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিতে। কিন্তু পুলিশ বলেছে, তারা কেন তথ্য দেবে। আর এখন তো যোগাযোগমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছি। তারা এখন তদন্ত করুক। সেই মন্ত্রী নেই। তদন্তে সমস্যা হবে না। বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির কথা বলেছে তাদের অবশ্যই এই দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে।

পদ্মাসেতু হওয়াটা অতীব প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পদ্মাসেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর কাজ কীভাবে বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দেয়। এর কোন যৌক্তিকতা আছে বলে জানি না। তবে আমরা যেভাবে হোক পদ্মাসেতু তৈরি করব। যেহেতু আমাদের টাকা নেই। কিন্তু সেতু করা দরকার। বেসরকারি অংশীদারিত্ব এ সেতু নির্মাণ করলে আমাদের কোনো টাকা লাগবে না। এতে আমাদের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার চাপ পড়বে না।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ^ব্যাংক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দুর্নীতি তদন্তের জন্য যোগাযোগ মন্ত্রী নিজেই দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল। বিশ^ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে দুর্নীতির তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তারা দুর্নীতির বিষয়ে কোনো নাম-ধাম দেখাতে পারেনি। অনুমান নির্ভর অভিযোগ করেছে।

পদ্মাসেতুর বিষয়ে বিশ^ব্যাংকের দুর্নীতি তদন্তের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিশ^ব্যাংক এ নিয়ে তদন্ত করছে করতে থাকুক। আমরা পদ্মাসেতু সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) দিয়ে দেব। বিশ^ব্যাংক টাকা ছাড় দিলে আমরা এটা অন্যান্য উন্নয়ন খাতে কাজে লাগাব।

মন্ত্রিপরিষদে সাম্প্রতিক রদবদল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে এটি স্বাভাবিক কাজ। এবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মন্ত্রিসভায় রদবদল করা হলো।’

গত ২৯ নভেম্বর ক্ষমতাসীন মহাজোটের মন্ত্রিসভার তৃতীয় দফায় সম্প্রসারণে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ওবায়দুল কাদের ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সুরঞ্জিতকে দেওয়া হয় নবগঠিত রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

পুরনোদের মধ্যে জি এম কাদের ও ফারুক খানের মন্ত্রণালয় অদল-বদল হয়। জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদের বাণিজ্য এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে ‘কম খাওয়ার পরামর্শ’ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়া ফারুক খান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন ইতিমধ্যে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর গত তিন বছরে বিভিন্ন ঘটনায় জাতীয় সংসদে ও বাইরে মন্ত্রীদের সমালোচনায় সরব ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

মন্ত্রীসভার রদবদল ও কেউ বাদ না পড়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন কোন অপরাধ পাইনি যে কেউ বাদ পড়বে। বাদ দিতে যাব কেন? কোন অভিযোগ তো কেউ তিন বছরে দিতে পারেনি। তাছাড়া সরকারের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯৪ ভাগ। আর মন্ত্রিসভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে তা বাস্তবায়নের হার ৯৩ ভাগ। প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ ভাগ। অতীতে কোনো সরকারই এটা করতে পারেনি। সরকারের মন্ত্রীরা যদি কাজই না করে তাহলে কীভাবে এগুলো বাস্তবায়ন হলো?

সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও জেলা সফর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন করে সংগঠন গোছানোর কাজ শুরু করেছি। নতুন বছর নয়, আগে থেকেই জেলা সফরের কাজ শুরু করে দিয়েছি। এরইমধ্যে কয়েকটি জেলায় আমি গিয়েছি। পর্যায়ক্রমে দেশের ৬৪টি জেলা আমি সফর করব। জেলা সফরের মধ্য দিয়ে তৃণমূল সংগঠনকে সংগঠিত করা হবে।

টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, এখন টিপাইমুখ নিয়ে অনেক কথা তোলা হচ্ছে। কিছু আগে কখনো কথা উঠেনি। তারা (বিএনপি) যখন ক্ষমতায় ছিলো এটা নিয়ে কথা কোন কথা বলেনি। উনি (খালেদা জিয়া) এখন এটা নিয়ে বিপ্লবই করে ফেলতে চান। অথচ তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ভারতে গিয়ে টিপাইমুখ নিয়ে কোন কথা বলেননি। ওটা ওনার স্মরণেই ছিলো না। আর গঙ্গার পানির কথা তো বলতে ভুলেই গিয়েছিলেন।

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের চলমান লংমার্চ প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরশাদ ১৯৮২ থেকে নব্বই পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এরশাদে সাহেবও কোন কথা বলেননি। এখন লং মার্চ করছেন। করুন, ভালো কথা।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হোক এটা অবশ্যই আমরা চাই না। এ ব্যাপারে আমরা যখন যে খবর পাচ্ছি, তার খোঁজ খবর নিচ্ছি। এর আগে আমরা সংসদীয় একটি দল পাঠিয়েছিলাম। আমার দু’জন প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। আমাদের কাপ্তাই হ্রদের মতো তারা সেখানে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করবে। পানি আটকাবে না।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ভারতকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কান কাজ করতে দেওয়া হবে না। সার্ভে শুরু হয়নি। সার্ভের সময় অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতিনিধি রাখতে হবে। অথবা অবশ্যই তথ্য সরবরাহ করতে হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এ দেশের সন্তান কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে থেকে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা করেছে। অগ্নি-সংযোগ করেছে। মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে। তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই হবে। এ বিচারের কাজ শুরু হয়েছে। এ বিচারের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বিরোধী দলীয় নেত্রী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবল¤¦ন করেছে এমন অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতায় দখল করে ১১ হাজার বন্দী যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেন। গোলাম আযমসহ অনেককে নাগরিকত্ব দিয়েছেন। তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। শাহ আজিজসহ অনেককে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন জিয়া। তার স্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, যারা এ বিচার বন্ধ করতে চায় দেশবাসী এদের বিচার করবে।

মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা বাণিজ্যের বিষয়ে কথা হয়েছে। আমাদের ব্যবসায়ীরাও গিয়েছিলেন, তারা কথা বলেছেন। সেখানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুতের ভাগ আনব। সার উৎপাদন করে তার ভাগ আনব। সেখানে শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলার মত অনেক জমি রয়েছে। ওই জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের কাছে অনুরোধ করেছি। এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর