গৌহাটির গৃহবধু জমিরন পারভীন। পরিবারের মধ্যে একমাত্র তিনিই বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা থেকে। শনিবার দুপুরে যখন জানতে পারেন, চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা বা এনআরসিতে তার নাম নেই, আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায় মুষড়ে পড়েছেন জমিরন। স্বামী আজম আলী মৃধা এবং শ্বশুর বাড়ির অন্যান্যরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ৮-৯ বছরের একমাত্র ছেলে বাচ্চাটি উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে দেখছে।
স্বামী-সন্তান এবং শ্বশুর বাড়ির সবারই চূড়ান্ত তালিকায় নাম রয়েছে। বাবার পরিবারের সবাই তালিকায় রয়েছেন। বাদ পড়েছেন একমাত্র তিনি। জমিরন বলেন, ‘খসড়া তালিকায় নাম না ওঠার পর সব সমস্ত কাগজপত্র দিয়ে আপিল করেছিলাম। কিন্তু তারপরও নাম নেই। জানিনা এখন আমার কী হবে।’
জমিরনের জন্ম আসামের বড়পেটায়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জমিরনের বাবার নামের বানান ভুল লেখা হয়েছিল বলেই এই পরিণতি। তার বাবার নাম আতব আলী, কিন্তু পরীক্ষার প্রবেশপত্রে নাম লেখা হয় আতাবর আলী। আর এই দুই অক্ষরের ভুলেই চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন এই নারীর। জমিরনের স্বামী জানালেন, তারা ট্রাইবুনালের আপিল করবেন। জমিরন পারভিন সহ আসামের ১৯ লাখেরও বেশী মানুষের নাম চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে।
এখন এই ১৯ লাখ বাংলাভাষী মানুষের কী হবে?
এখনই তারা রাষ্ট্রহীন হচ্ছেন না। বাদ পড়া এই মানুষদের আপিলের জন্য ১২০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে তৈরি ট্রাইবুনাল ছাড়াও তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করতে পারবেন। তবে ভারতের সমস্ত আদালতগুলো এমনিতেই সারা বছরই মামলার চাপে পর্যুদস্ত। ফলে আদালতে গিয়ে দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যয়বহুল আপিল প্রক্রিয়ার সুবিধা কতজন নিতে পারবেন তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিস্তার সন্দেহ রয়েছ।
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র, অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষগুলোর জন্য এই আপিল প্রক্রিয়ায় ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যারা আপিলে অসফল হবেন বা এই প্রক্রিয়াতে ঢুকবেনই না, তারা রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়বেন – সেই সম্ভাবনাই প্রবল।
ট্রাইবুনালের প্রতি আস্থার অভাব
আসামের লেখিকা সঙ্গিতা বড়ুয়া পিশারডি বলেন, ‘যাদের নাম চূড়ান্ত তালিকাতে নেই তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে তাদের এখন কী হবে। তার প্রধান কারণ ফরেনার্স ট্রাইবুনালের ভাবমূর্তি ভালো না, মানুষের আস্থা নেই। ফলে সেখানে গিয়ে আদৌ কাজ হবে কিনা তা নিয়ে বহু মানুষ সন্দিহান।’
নাগরিকত্ব নির্ধারণে আসামে, এখন এ ধরনের ২০০টি বিশেষ আদালত বা ট্রাইবুনাল রয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। অক্টোবরের মধ্যে এ ধরণের ট্রাইবুনালের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০০। এসব আদালতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের বিস্তর অভিযোগ রয়েছ। তাদের কাজের মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রমাণের সমস্ত দায় বর্তায় বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তির ওপর। লাখ লাখ দরিদ্র, নিরক্ষর মানুষের কাছে সবকিছুর লিখিত রেকর্ডও নেই।
সাংবাদিক রোহিনী মোহন আসামের একটি জেলায় এসব ট্রাইবুনালের ৫০০টিরও বেশি রায় বিশ্লেষণ করে দেখতে পান ৮২ শতাংশ অভিযুক্তকেই বিদেশি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে । ৭৮ শতাংশ রায় হয়েছে অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনেই। বলা বাহুল্য বিদেশি হিসাবে ঘোষিত এসব মানুষদের সিংহভাগই মুসলমান। তবে বাংলাভাষী হিন্দুর সংখ্যাও কম নয়। এমনকি মোহাম্মদ সানাউল্লাহ নামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক এক সদস্য, যিনি তার কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তাকে পর্যন্ত বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত করে ১১ দিন আটকে রাখা হয়েছিল।
এই ‘বিদেশি’দের পরিণতি কী হবে?
তাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা হতে পারে। যে হাজার খানেক মানুষকে আসামে ইতিমধ্যেই বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের বিভিন্ন কারাগারের ভেতর ৬টি আটক কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখন একটি আলাদা আটক কেন্দ্র তৈরি করছে যেখানে ৩০০০ লোককে রাখা যাবে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বার বার জোর দিয়ে বলেছে অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বলে দিয়েছে আসাম থেকে তারা একজনকেও গ্রহণ করবে না।
এটা আরেক রোহিঙ্গা সঙ্কট
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মত ভারতের আসামে বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রহীন মানুষ তৈরি হতে চলেছে। তাদের জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে কিনা তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ইঙ্গিত নেই। সরকারি শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবা তারা পাবেনা কিনা তাও নিশ্চিত নয়। সবচেয়ে বড় কথা, জমিজমা রাখতে পারবেন কিনা সেটাও অস্পষ্ট ।
একটা ধারণা রয়েছে যে রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়া মানুষগুলোকে হয়তো কাজ করার পারমিট দেওয়া হতে পারে এবং কিছু মৌলিক অধিকার দেওয়া হতে পারে। তবে ভোটের অধিকার থাকবে না – এটা নিশ্চিত।