কড়া কড়া আওয়াজ দিয়েও লাগাতার আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ থেকে সরে যাচ্ছে বিরোধী দল। ১৮ দলীয় জোটের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শীর্ষ নেতা কারাবাসে যাওয়ার পর তাদের সরকার বিরোধী কর্মসূচিতেও ভাটা পড়েছে বেশ। তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবিতে দেওয়া আলটিমেটাম শেষ হওয়ার দিন ১০ জুন এগিয়ে এলেও তাই বিরোধী দলের আন্দোলনে যেন অনেকটাই ঢিমেতাল। বিদেশি কূটনীতিকদের চাপে তারা এখন সংলাপের দাবিই জপছে।
বিরোধী দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলনের ময়দান থেকে উঠে সরকারের সঙ্গে বহুল আলোচিত সংলাপে বসতেই বেশি আগ্রহী তারা।
সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি আর কর্মসূচি বিশ্লেষণেও তাদের এই ঢিমে তেতালা ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় গত ১৬ মে শীর্ষ নেতাদের কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদে পরদিন ১৭ মে সারাদেশে পালিত সকাল-সন্ধ্যা হরতালই গত দশ দিনের একমাত্র বড় কর্মসূচি বিরোধী দলের। এরপর ২০ মে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণঅনশন কর্মসূচি পালিত হলেও তা ছিল পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিরই বাস্তবায়ন মাত্র।
এরপর বিরোধী দল এখন পর্যন্ত নতুন কর্মসূচি নিয়ে যেমন মাঠে নামেনি, তেমনি আগামী ১০ জুনের আগে বড় কোনো কর্মসূচি পালনেরও ঘোষণা দেয়নি। এ যেন দায়সারা বিক্ষোভ, মানববন্ধন আর গোলটেবিল বৈঠকে কালক্ষেপণেরই কৌশল।
গত ১৬ এপ্রিল ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বিরোধী দল মাত্র দু’সপ্তায় দু’দফায় পাঁচ দিন হরতাল দিয়ে লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, মীর্জা আব্বাস, ব্রিগেডিয়ার (অব.) আসম হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-মহাসচিব রহুল কবীর রিজভী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম, বাংলাদেশ জাতীয় পর্টি (বেজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর বিরোধী দল এখন লাগাতার আন্দোলনের আওয়াজ থেকেই সরে গেছে যেন।
এদিকে রুটিন মানববন্ধন-গোলটেবিল আর বিক্ষোভ সমাবেশে ঘুরে ফিরে সংলাপে বসার আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পাচ্ছে বিরোধী দলের বক্তব্যে। সাম্প্রতিক সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিদেশি কূটনীতিকরা সংলাপে বসার জন্য পরামর্শ ও তাগিদ দিয়েছেন। এখন সে পথেই এগিয়ে যেতে চাইছে বিরোধী দল।
ইতিবাচক ইমেজধারী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিও খালেদা জিয়ার অনশন-মঞ্চে গিয়ে সংলাপের পরামর্শ দেওয়ায় বিরোধী দলের সংলাপ আকাঙ্ক্ষার পালে যেন হাওয়া লেগেছে ।
এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দফায় দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি উড়িয়ে দিলেও হাল ছাড়ছে না বিএনপি ও তার শরিকরা।
তাদের সব ইস্যুই যেন এখন এসে মিলছে তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সংলাপে বসার আকাঙ্ক্ষায়। তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ড, ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি, খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেওয়া আর কারান্তরীণ নেতাদের নি:শর্ত মুক্তির দাবি ছাপিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের বক্তব্য ও আচরণে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আলোচনার আহবানই প্রধান হয়ে ফুটছে। এমনকি চাপা পড়ে পড়ে যাচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সঙ্কট সমাধান, জ্বালানি তেল ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুও।
সব ছাপিয়ে এখন যেন সংলাপেরই অপেক্ষা করছে বিরোধী দল। এজন্য, একটা দরকষাকষির পরিবেশও তৈরি করতে চাইছে তারা।
এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন ১৮ দলীয় জোটের নেতা খালেদা জিয়া। নিত্যদিনের আলোচনা-সমাবেশে একই কথা আওড়াচ্ছেন তার দল ও জোটের নেতারাও।
তারা মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী আপাতত তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু বাদ দিয়ে আলোচনায় বসার কথা বললেও সংলাপ হবে এবং তা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল এখন শুধু বিএনপির নয়, সবার প্রাণের দাবি। শুধু দেশের নয়, দেশের বাইরে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও এটাই চাওয়া। তাই আমরা সংলাপে বসতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক বলেন, ‘তারা না চাইলে আমরা তো বাধ্য করতে পারবো না, যুদ্ধে নামতে পারবো না, তাদের মতো আমাদের হাতে কোনো বাহিনীও নেই। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনগণের চাওয়ার অসম্মান করে কেউ ক্ষমতায় টিকতে পারেনি।’
বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার পুনর্বহাল ইস্যুতে সংসদের ভেতরে বা বাইরে যে কোনো স্থানে বসতে রাজি। তবে সেটা শুধুই তত্ত্বাবধায়ক বহাল প্রসঙ্গে। এই ইস্যু বাদ দিলে বৈঠক অর্থহীন হয়ে যাবে।’
সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য প্রসঙ্গে নোমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য কি ইস্যুতে কথা বলতে চান তা তো স্পষ্ট করে বলেননি। তার বোঝা উচিত- দলীয় সরকারের অধীনে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাবে না। জনগণ দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনের রায় মেনে নেবে না। তাই আমরা এখনো আশা করি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাববেন।’