ভারতীয় উপমহাদেশে বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই ( ইন্নালিল্লাহে…. রাজিউন)। আজ সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার হয়েছিল ৯৭ বছর।
তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পরিতোষ দেবনাথ। তিনি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আজ রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে মোজাফফর আহমদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই তিনি রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ছয়জন উপদেষ্টার মধ্যে একজন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তিত্ব ১৯৩৭ সালে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়েছেন। তিনি যখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক তখন থাকতেন আজমপুরে আট/ আই কলোনির বাসাতেই। সেখানেই ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার মিটিং হয়েছিল।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মোজাফফর আহমেদ দেবীদ্বার থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তদানীন্তন মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্থানকে স্বায়ত্ত্বশাসিত করার প্রস্তাব করে তিনি অনেক রাঘব বোয়ালের রাজনীতিতে ধাক্কা দিয়েছিলেন। যদিও বা সেই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, তথাপি তখন সেটা খুব সহজ কথা ছিলনা। না বললেই নয়, পূর্ব পাকিস্থান গণপরিষদে তার প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতা করে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইতিহাসের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফা প্রথমদিকে যারা জোরালোভাবে সমর্থন করে এগিয়ে নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।
১৯৬৮ সালে ন্যাপ দু`ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগ মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকলেও অন্য অংশ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ছয় জন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। যেখানে মাওলানা ভাসানী, মণি সিং, মনোরঞ্জন ধরের মতো রাজনীতিবিদরা ছিলেন। তাদের অন্যতম কমরেড মোজাফফর আহমেদ। বাম সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে তখন একটি বিশাল মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীও গঠন করা হয়েছিল। তার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশে জনমত গঠন করতে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। তাকে তখন জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতেও হয়েছিল।
১৯৭৯ সালে তিনি পুনরায় দেবীদ্বার থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে `কুঁড়েঘর` মার্কায় প্রার্থী হন। `আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর` এই স্লোগানে দোকানে দোকানে তাকে সহজ সরল ভাবে ভোট চাইতে দেখা যায়। যদিও বা পাতানো সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ তথাপি বন্দুকের নলের দিকে বুক তাক করে করা সেই সাহসী রাজনীতি ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে।
নিরিবিলি রাজনীতি করার সুযোগ তিনি কখনো পাননি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান তার নামে হুলিয়া জারি করেন। তখন তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিল। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বেশীর ভাগ সময় তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। শুধুমাত্র রিক্সাভাড়া পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এরশাদ ক্ষমতায় এলে তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। তার স্ত্রী আমিনা আহমেদ স্কুলে চাকরী করে সংসার চালাতেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে বারিধারার পার্ক রোডে মেয়ের বাড়িতে থাকেন তিনি। গত ১৪ আগস্ট অধ্যাপক মোজাফফরকে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। ছিলেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।