বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠান নজরুল ও বঙ্গবন্ধু একই সমান্তরালে: প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠান নজরুল ও বঙ্গবন্ধু একই সমান্তরালে: প্রধানমন্ত্রী

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে একই সমান্তরালে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী ও বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বর্ষ পূর্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

শুক্রবার সকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান শুরু হয়।

শেখ হাসিনা বলেন,‘বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া। নজরুলও চেয়েছিলেন বঞ্চনাহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে। দু’জনের একই স্বপ্ন ছিল। যেখানে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, সব মানুষ এক হয়ে বাস করবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নজরুল দুজনই ছিলেন বিদ্রোহী। একজন সাহিত্যে, অন্যজন রাজনীতিতে। দুজনই মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘নজরুল সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি। তার কাছে ধর্ম, গোত্র, জাত-কুল, ধনী-গরীব সব শ্রেণীর মানুষ সমান। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কুফল তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেজন্য তিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কূপমুণ্ডকতার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘নজরুলের আকাঙ্খা ছিল একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ। বঙ্গবন্ধুরও ইচ্ছে ছিল শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার।’

এজন্যই দর্শনগত দিক দিয়েও নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু একই সমান্তরালে ছিলেন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কাব্য প্রতিভার জন্ম নেওয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘নজরুল ইসলামের অনেকটা সময় বাংলাদেশের নরম কাদামাটিতে কেটেছে। ময়মনসিংয়ের দরিরামপুরে তিনি ছিলেন অনেকদিন।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দু’জন কবিরই শ্বশুর বাড়িই বাংলাদেশে। নজরুল কুমিল্লায় বিয়ে করেছিলেন।’

প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে চল চল চল গানটি রণসঙ্গীত হিসেবে মনোনয়ন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর কবিকে বাংলাদেশে আনার জন্য ভারতের ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরে তাকে এ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।’

নজরুলের পরিবারকে ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নজরুলকে দেখতে মাঝেমধ্যেই ওই বাড়িতে যেতেন বলেও শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন।

কাজী নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দেশের বিভিন্ন স্থানে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।

তিনি বলেন,‘অনেকে মনে করেন, শুধু আজকের জন্মজয়ন্তীর দিন বা বিদ্রোহী কবিতর ৯০ বছরের দিনটিই শুধু পালন করবো, তা নয়, আমাদের জীবনে নজরুল সবসময়ই রয়েছেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সব জনপ্রিয় ভাষায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম অনুবাদের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘এ ব্যাপারে সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নজরুল ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে কিছু কিছু রচনা ইতিমধ্যে ইংরেজি, ফরাসি, লাতিন, চীনা, হিন্দি ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বর্তমানে আরবি ভাষায় এর অনুবাদের কাজ চলছে।’

অনুষ্ঠানে ভারতের আইন, বিচার ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী সালমান খুরশিদ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন তথ্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ।

জাতীয় কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালি জীবনের এমন কোন অনুসঙ্গ নেই, যেখানে নজরুলের চিন্তার ফসল নেই। কেবল ভাষা সংস্কৃতি নয়, জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে নজরুল ভাবনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।’

তিনি বলেন, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্খা পূরণে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার কাজে দেশের সবাইকে আত্মনিয়োগ করতে হবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দারিদ্রের বেড়াজাল ভেঙে আমরা চাই এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি এবং জাতির পিতা।’

তিনি বলেন, ‘যে বাংলাদেশে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না, নারী তার প্রাপ্য অধিকার ভোগ করতে পারবে, সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করবে, সমাজ থেকে অশান্তি দূর হবে। আসুন, আমরা সকলে মিলে সেই বাংলাদেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি।’

বিদ্রোহী কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নজরুলের প্রায় সমস্ত রচনাতেই আর্ত-পীড়িত, ব্যথিত ও উপেক্ষিত মানব মনের ব্যথা কাব্যাকারে ফুটে উঠেছে। নজরুল বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে শুধু বিদ্রোহ নয়, একটি বিপ্লব সংঘটিত করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘দ্রোহ কবি নজরুলের লেখনীর মূল সুর। কিন্তু এটাই তার লেখনীর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি ছিলেন সুন্দরের কবি, হৃদয়াবেগের কবি। তার গানে প্রেম ও প্রকৃতি অপরূপ রূপে ধরা দিয়েছে।আমাদের আনন্দ-বেদনা-বিরহে নজরুলকে পাই একান্ত আপনজন হিসেবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্রোহী কবিতায় কবির এই দীপ্ত উচ্চারণ আজও প্রতিটি বাঙালি এবং বাংলা ভাষাভাষীকে সমানভাবে আলোড়িত করে। অন্যায়, অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সাহস ও শক্তি জোগায়।’

ঔপনিবেশিক শাসনামলে রাজদ্রোহের অপরাধে কবির কারাবাসের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারাবাস কবিকে দমাতে পারেনি। বরং অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে তার আক্রমণের ভাষা আরও তীব্র ও শাণিত হয়েছে।’

এর আগে বক্তব্য রাখেন ভারতের প্রতিনিধি হয়ে ঢাকা আসা ভারতের আইনমন্ত্রী সালমান খুরশিদ।

নজরুলের কবিতা ও সাহিত্য বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের মনে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ভারতের আইনমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী যৌথভাবে আয়োজনের জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।

খুরশিদ বলেন, ‘যৌথ আয়োজন দুই দেশের সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পটভূমিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে। দু’দেশের বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।’

তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী প্রমুখ।

নজরুল ইন্সটিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রফেসর এমিরিটাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল বিষয়ক সাবেক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে আবৃত্তিকার আবু জাফর সিদ্দিককে সব্যসাচী পদক তুলে দেওয়া হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেন। এতে দুই দেশের শিল্পীরা পরিবেশন করেন নজরুলের গান, কবিতা থেকে আবৃত্তি ও নৃত্য।

যৌথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারতীয় নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ও আবৃত্তিশিল্পীর সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা এসেছে। এ দলে রয়েছেন বাঁধন চন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রদীপ ঘোষ, সুস্মিতা গোস্বামী ও নবারুন ভট্টাচার্য। এছাড়াও সালমান খুরশিদের সঙ্গে ঢাকা আসেন লোকসভার সদস্য ড. ভোলা সিং ও চংসেন মঙকোসুঙকুম চ্যাঙ।

যৌথ অনুষ্ঠান হিসেবে শুক্র ও শনিবার শিল্পকলা একাডেমীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এখানেও দুই দেশের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেবেন।

ঢাকার সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে কবি নজরুল সংক্রান্ত বই প্রদর্শনীর আয়োজন রাখা হয়েছে। এছাড়া নজরুল স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়া কবির আদর্শকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে বাংলাদেশ নজরুল ইনস্টিটিউট বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক ও বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রশিক্ষণ, নজরুলের ওপর গ্রন্থ প্রকাশ, শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীতের সিডি প্রকাশ, বিদেশি ভাষায় নজরুলের রচনা অনুবাদ প্রভৃতি।

বাংলাদেশ