দশ ট্রাক অস্ত্র খালাসের সঙ্গে এনএসআই’র কতিপয় কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্তে জানার পরও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বাধা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে এ কথা বলেছেন অস্ত্র আটকের ঘটনা তদন্তে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির আহ্বায়ক ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক।
চট্টগ্রামের চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবর রহমানের আদালতে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুকের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে।
এরপর আদালত আগামী ১২ জুন এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন।
বাংলানিউজকে এ কথা জানিয়েছেন মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ।
সাক্ষ্য প্রদানের শুরুতে ওমর ফারুক বলেন, ‘২০০৪ সালের ২ এপ্রিল আমি টেলিভিশনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারূদ আটকের খবর জানতে পারি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আমি ছিলাম।’
তিনি জানান, তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন, ডিজিএফআই’র ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই’র ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহমদ চৌধুরী এবং ডিআইজি (এসবি) শামসুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমরা তদন্ত কমিটির সদস্যরা ২০০৪ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামে যাই। সেখানে ঘটনাস্থল ও পারকি বাজার পরিদর্শন করি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যথা-সিইউএফএল কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের আলাপ করি। ওইসময় এনএসআই’র কতিপয় কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার কথা বুঝতে পারি ও ধারণা পাই। কিন্তু সময়ের স্বল্পতা হেতু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।”
ওমর ফারুক বলেন, “প্রতিবেদন তৈরির সময় তদন্তে পাওয়া বিভিন্ন বিষয় এনএসআই’র গুটিকয় কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর মহোদয়কে অবহিত করি।”
তিনি আরও বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদনে এনএসআই’র কতিপয় কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয় অর্ন্তভুক্ত করার প্রয়োজন থাকা স্বত্ত্বেও তা প্রতিমন্ত্রী মহোদয় করতে দেননি। এ বিষয়টি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বাধা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিবেদনে অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এর বেশি কিছু করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কিছু সুপারিশ আমি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।:
এ পর্যায়ে আদালত টানা চারদিন ধরে চলা দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম আগামী ১২ জুন পর্যন্ত মূলতবির ঘোষণা দেন।
এর আগে বেলা পৌনে ১২টা থেকে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এস এম সাব্বির আলীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের পাঁচ আইনজীবী।
এদিকে এ মামলার আসামিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত আসামি ও পুলিশের মধ্যে হট্টগোল হয়েছে। এছাড়া এস এম সাব্বির আলীকে জেরা করার সময়ও রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর মধ্যে কয়েকবার বাদানুবাদ হয়। এর মাঝে লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদারের দীর্ঘসময় নিয়ে জেরা করা নিয়ে আদালতও বিরক্তি প্রকাশ করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ১০ মিনিটে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। বিচারিক আদালতের কক্ষে প্রবেশের পর মতিউর রহমান নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়া বাকি ৮ জন আসামিকে ডকের ভেতর ঢোকাতে চাইলে আসামি রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী চিৎকার শুরু করেন। এসময় তিনিসহ কয়েকজন আসামি পুলিশের উপরও চড়াও হন।
এসময় বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান এজলাসে উপস্থিত ছিলেন বলে আদালত সূত্র জানায়।
এর আগে বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামীপক্ষের আইনজীবীদের বাদানুবাদ এবং হট্টগোলের পর বিচারক সাবেক দু’মন্ত্রী ছাড়া বাকি আসামীদের ডকে ঢোকানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বুধবার এস এম সাব্বির আলীর আংশিক সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালতের কার্যক্রম বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়।
বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টায় আবারও এসএম সাব্বির আলীর জেরা শুরু হয়।
২০০৪ সালে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি যখন ধরা পড়ে তখন এস এম সাব্বির আলী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সালের ২ফেব্রুয়ারি তিনি অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক হিসেবে চাকুরী থেকে অবসর নেন।
আসামিদের মধ্যে যারা আদালতে হাজির ছিলেন তারা হলেন, জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র তৎকালীন পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন, উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিইউএফএল’র সাবেক এমডি মোহসীন তালুকদার, চোরাচালানী হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান ও ট্রলার মালিক দীন মোহাম্মদ।
অসুস্থ থাকায় সিইউএফএল’র সাবেক মহাব্যবস্থাপক এনামুল হককে আদালতে হাজির করা হয়নি।
এছাড়া সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত দু’আসামি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রণ্ট অব আসাম (উলফা) ’র সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়–য়া ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নূরুল আমিন বর্তমানে পলাতক আছেন।
উল্লেখ্য ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়ে।
বিগত তত্তাবধায়ক সরকারের আমল থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর অধিকতর তদন্তের পর ২০১১ সালের ২৬ জুন সিআইডি আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার।
এ মামলায় তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক শিল্পসচিব ড. শোয়েব আহমেদ, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএইফআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, ডিজিএফআই’র সাবেক ডিটাচমেন্ট কমান্ডার কর্ণেল (অব.) এ কে এম রেজাউর রহমান, এনএসআই’র সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী এবং সিএমপি’র সাবেক পুলিশ কমিশনার এস এম সাব্বির আলী, বন্দর জোনের তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল্লাহ হেল বাকী ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুর রহমান সহ ১১ জন এরই মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।