গত মাসের শেষ দিনে বেশ ঘটা করেই ঘোষণাটা দিয়েছিল রংপুর রাইডার্স। ঢাকা ডায়নামাইটসের সাকিব আল হাসান এবারের বিপিএলে তাদের হয়ে খেলবেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের সঙ্গে সাকিবের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপা হলো। সাকিব বললেন, তিনি রংপুরে গিয়ে খুশি। রংপুরও সাকিবকে পেয়ে আনন্দিত।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও সাকিবের দলবদলের মতোই শোনা যাচ্ছিল আরও দুটি গুঞ্জন। তামিম ইকবাল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস ছেড়ে খুলনা টাইটানসে আসবেন। মুশফিকুর রহিম কুমিল্লায় যাবেন চিটাগং ভাইকিংস থেকে। বিদেশি কয়েকজন তারকারও বিপিএল-ঠিকানা ঠিক হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছিল। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক এউইন মরগান ঢাকা ডায়নামাইটসে, রাজশাহী কিংসে পল ডুমিনি। কিন্তু কাল এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের হয়ে বিসিবি পরিচালক মাহবুবুল আনাম যা বললেন, তাতে দলবদলের ওসব খবরের এখন আর কোনো মানে থাকল না।
ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী, সপ্তম আসর থেকে বিপিএল গড়াবে চার বছরের নতুন চক্রে। আর নতুন চক্র মানেই ফ্র্যাঞ্চাইজি-গভর্নিং কাউন্সিলের মধ্যে নতুন করে চুক্তি। সে চুক্তি হওয়ার পরই ঠিক হবে খেলোয়াড় নিলামের নিয়ম-কানুন। ‘আইকন’ বা ‘এ প্লাস’ শ্রেণি থাকবে কি না, পুরোনো খেলোয়াড় ধরে রাখা যাবে কি না, ‘আইকন’রা স্বাধীনভাবে অন্য দলে যেতে পারবেন কি না—নতুন চক্রে এই সবকিছুর ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত হবে নতুন করে। সাকিবসহ তিন আইকন যে এর মধ্যেই নতুন দলে যাওয়া নিশ্চিত করেছেন, সে বিষয়ে কথাই বলতে চাননি মাহবুবুল আনাম। বিপিএল যেখানে নতুন করে শুরু হচ্ছে, সেখানে এসব নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি।
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে মাহবুবুল আনামের দুই পাশে ছিলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের ছয় কর্মকর্তা। তবে তাঁরা কেউ কিছু বললেন না। গভর্নিং কাউন্সিলের কেউ না হয়েও সব ব্যাখ্যা দিলেন মাহবুবুল আনাম। জানালেন, বিপিএলের সব ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নতুন চুক্তির জন্য আলোচনায় আসতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিঠি দেওয়া হবে। চিটাগং ভাইকিংস আসবে নতুন মালিকানায়, যোগ হতে পারে অষ্টম ফ্র্যাঞ্চাইজিও। যদিও রাতে জানা গেছে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বর্তমান আরেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি বিপিএলে আর না–ও থাকতে পারে বলেই দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানার জন্য আবেদনপত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে বিসিবি। মাহবুবুল আনামের আশা, এ মাসের মধ্যেই নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়া এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। আগামী ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা সপ্তম বিপিএল। সব শ্রেণিতে খেলোয়াড় নিলাম হবে এর মাস দুয়েক আগে।
বিসিবির হঠাৎ এত কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল আসলে সাকিব রংপুরে নাম লেখানোতেই। এক সাকিবের কারণেই অসময়ে বিপিএল নিয়ে এত হইচই। মুশফিক, তামিমের দলবদলের গুঞ্জন যখন এল, বিদেশিদের নাম যখন শোনা গেল, তখনো বিসিবির মনে হয়নি, আরে, এবার তো বিপিএল নতুন চক্রে ঢুকছে! তাহলে দলগুলো আগেভাগে খেলোয়াড় নিচ্ছে কীভাবে? রংপুর সাকিবকে দলে টানার ঘোষণা দেওয়ার পরই নড়েচড়ে ওঠেন গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যরা। গত তিন-চার দিনে তারা নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক করেন। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কাল মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনের আগেও গভর্নিং কাউন্সিল আরেকবার সভায় বসে। কেন, কী কারণে এত বসাবসি, সে ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনের আগে কর্মকর্তারা কেউই কিছু বলতে রাজি হননি। তবু উদ্দেশ্যটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও—সাকিবের রংপুর গমন ঠেকাও।
নিয়মের মারপ্যাঁচে তাতে আপাতদৃষ্টিতে সফল গভর্নিং কাউন্সিল। চুক্তিতে যদি থাকেই যে সপ্তম আসর থেকে বিপিএল নতুন চক্রে গড়াবে, সেটি জানা উচিত ছিল রংপুর রাইডার্সেরও। তবে এ নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিটির প্রধান নির্বাহী ইশতিয়াক সাদেক বললেন ভিন্ন কথা, ‘আমরাও জানি এবার নতুন করে চুক্তি হবে। তবে গত জুনে গভর্নিং কাউন্সিল আমাদের ই–মেইলে এবারের বিপিএলের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তা ছাড়া গত বিপিএলের আগে সব ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নিয়ে একটি সভায় গভর্নিং কাউন্সিল জানিয়েছিল, সেবারের নিয়ম-কানুন পরবর্তী তিন বছর বলবৎ থাকবে। সে হিসাবে তো সাকিব দল বদলাতেই পারে।’ মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়া সাকিব এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
সাকিবের দুর্ভাগ্য বটে। ‘আইকন’ বা ‘এ প্লাস’ শ্রেণির ক্রিকেটারদের দল বদলানোর ঘটনা বিপিএলের প্রতি মৌসুমেই ঘটেছে। অথচ তিনি যখন নতুন ঠিকানায় যেতে চাইলেন, তখনই পড়লেন বাধায়! ২০১৬ সালের বিপিএলের আগে এটা নিয়মই করে দেওয়া হয় যে আইকন খেলোয়াড়েরা চাইলে স্বাধীনভাবে ফ্র্যাঞ্চাইজি বেছে নিতে পারবেন। রংপুর থেকে সেবারই ঢাকায় আসেন সাকিব। তা ছাড়া গত বিপিএলের ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের কাছে হারের পর ঢাকা ডায়নামাইটস থেকেই শোনা গিয়েছিল, এবার তারা সাকিবকে রাখবে না। সাকিবের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজির কেউ কেউ। এমনকি এবার বিশ্বকাপের আগেও সে রকমই মনোভাব ছিল তাদের। সাকিবের নতুন দল খোঁজার সেটিও একটি কারণ। কিন্তু সেই ঢাকা সাকিবকে হারিয়ে এত ‘শোকার্ত’ কেন? আসলে বিশ্বকাপে অমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর সাকিবকে হারাতে চাইবে কোন দল!
নতুন প্রেক্ষাপটে অবশ্য সুযোগ পেলেও সাকিবকে হয়তো রাখবে না ঢাকা। কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেলিয়ে যে ভালো পারফরম্যান্স আশা করা যায়