চারতলা ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে হিমুকে নৃশংস নির্যাতনের পর কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল একসময়ের সহপাঠী রিয়াদ, সাজু, ড্যানি ও শাওন। গুরুতর আহত হিমু ২৬ দিন হাসপাতালে থাকার পর বুধবার রাতে প্রাণ হারান।
হিমুর মৃত্যু ছিলো বৃহস্পতিবার বন্দর নগরীর প্রধান আলোচনার বিষয়।
হিমুর ওপর নৃশংস নির্যাতনের পর ২৮ এপ্রিল সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও বুধবার (২৩ মে) মৃত্যুর পর মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
হিমুর পুরো নাম হিমাদ্রী মজুমদার। চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ইংরেজি মাধ্যমের সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ‘এ’ লেভেলের শিক্ষার্থী ছিল সে।
ছেলেকে হারিয়ে বাবা প্রবীর কান্তি মজুমদারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও খুনিদের উপর্যুপরি হুমকিতে এখন তিনি দিশেহারা। হিমুর ভাই লিনাদ্রির জীবন নিয়েও শঙ্কিত তিনি। লিনাদ্রি হিমুর স্কুলে ‘ও’ লেভেলে পড়ে।
বৃহস্পতিবার মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন হিমুর নির্বাক বাবা প্রবীর মজুমদার। কান্না চেপে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রথমে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এখন সন্তানের খুনিদের বিচারের জন্য মামলা করেছি।’
সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক প্রনমেশ সাংবাদিকদের বলেন, “হিমুকে আমি পড়িয়েছি এবং তাকে ভালো ছেলে হিসেবেই জানতাম। সংবাদপত্রে দেখেছি হিমুকে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে মারা হয়েছে।”
অনুসন্ধানে জানা যায়, রিয়াদ, সাজু, ড্যানি ও শাওন সহপাঠী হিমুর সঙ্গে রাউজানে মেজবান খাওয়ার গল্প ফেঁদে নীলনকশা চূড়ান্ত করেছিল। এরপর ২৭ এপ্রিল (শুক্রবার) দুপুরে রাউজানের এক আত্মীয়ের বাড়িতে সহপাঠীরাসহ মেজবান খেতে দুপুরের মধ্যে মাস্টারমাইন্ডের ন্যাশনাল কারিকুলাম স্কুলের মোড়ে জড়ো হওয়ার কথা হয়।
যথারীতি হিমু নির্ধারিত সময়ের আগে ওই মোড়ে এসে হাজির হলে আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা হিমুর সাবেক চার সহপাঠী তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়।
এরপর কী ঘটেছিল তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিমুর আরেক সহপাঠী বিস্তারিত বিবরণ দেয়। ওই সহপাঠী জানায়, জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, সাজু, ড্যানি ও শাওন নামের চার যুবক হিমুকে টানাটানি করে রিয়াদের বাসায় (মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলাম ভবনের তৃতীয় তলা) নিয়ে যায়। এই সময় হিমু তার ঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের ফোন করতে চাইলেও ওই যুবকরা হিমুর মোবাইলটি রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে চাপ দিতেই ভেঙে যায়। হিমুকে রিয়াদের বাসায় নিয়ে প্রচণ্ড মারধরের একপর্যায়ে চারতলার ছাদে নিয়ে যায়।
ছাদে ছিল জার্মানির হিংস্র প্রকৃতির ৫টি ডোবারম্যান জাতের কুকুর। হিমুকে কামড়ানোর জন্য জানোয়ারগুলো লেলিয়ে দেয় রিয়াদ, সাজু, ডেনি ও শাওন। একপর্যায়ে ছাদের ওপর থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পরে সার্জিস্কোপ হাসপাতালে (ইউনিট-২) নেওয়া হয়।
হিমুর অবস্থার আরও অবনতি হলে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ দিন পর বুধবার রাতে সেখানেই হিমু মারা যায়।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, মৃত্যুর আগে হিমু একটি জবানবন্দি দিয়ে গেছে। যা তার ‘স’ আদ্যক্ষরের এক সহপাঠীর কাছে রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ‘ফরহাদ ম্যানশন’ নামের ১০১ নম্বর বাড়ির নিচতলা ও চতুর্থতলা মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলামের শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় ভবনের মালিক ফরহাদ হোসেন ও তৃতীয় তলায় জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদের বাবা শাহ সেলিম টিপু থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, চতুর্থ তলার ছাদের মুখে কালো রঙের জার্মানির লেজকাটা ডোবারম্যান জাতের কুকুর রয়েছে। প্রায় ২০-২৫ দিন আগে এক শুক্রবার দুপুরে ছাদের ওপর থেকে একটি ছেলে পড়ে যায়। সেইসময় সাহেবের ছেলে রিয়াদ থাকলেও ওইদিন রাতেই তিনি লন্ডনে চলে যান বলে জানা যায়।
এদিকে ঘটনার দিন হিমুকে প্রথম উদ্ধার করেছিলেন পাশের নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ শাহজাহান।
নিরাপত্তাকর্মী শাহজাহান বলেন, ‘ওই দিন বেলা ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে ওপর থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পাই। কাছে গিয়ে দেখি একটি ছেলে পড়েছে। পরে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত মেডিক্যালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিমুর ওপর লেলিয়ে দেওয়া জার্মানির ডোবারম্যান জাতের কুকুর বিশ্বের হিংস্র কুকুরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এগুলো প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক থাকে। একসময় এ জাতের একেকটি কুকুরের দাম ৫০ হাজার টাকা থাকলেও এখন ১৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
হিংস্র কুকুর লেলিয়ে হিমুকে হত্যার কথা জানিয়ে মামলার বাদী ও হিমুর মামা প্রকাশ দাশ অসিত বলেন, “আমার ভাগিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই শাহ আলম টিপুর ছেলের নেতৃত্বে সহপাঠীরা বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে শারীরিক নির্যাতন ও পরে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে হিমুকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিল হিমুর সহপাঠীরা ।”
তিনি বলেন, “হিমু হত্যাকাণ্ডের জন্য শাহ সেলিম টিপুসহ তার ছেলে জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, সাজু, ডেনি, শাওনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।”
মামলার কথা স্বীকার করে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলমগীর হোসাইন বলেন, ‘হিমুর ঘটনায় ৩০২/৩৪ ধারায় হত্যা মামলা নেওয়া হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এ মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”