মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের ওপর রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য লিখিত আকারে জমা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে বুধবার সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আবেদনের পক্ষে দ্বিতীয় দিনের মতো বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এরপর আসামিপক্ষের যুক্তির বিপক্ষে মৌখিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হারদার আলী। ট্রাইব্যুনাল তাকে মৌখিক এ বক্তব্য আগামী ২৯ মে মঙ্গলবার লিখিত আকারে জমা দিতে নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে মানিক পসারি, মধুসদন ঘরামীসহ রাষ্ট্রপক্ষের তিন সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার জন্য আসামিপক্ষের করা রিকল আবেদনেরও জবাব দেওয়ার জন্য ২৯ মে ধার্য করেন আদালত।
এরপর সাঈদীর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলালউদ্দিনকে আসামিপক্ষ জেরা করে। আগামী রোববার পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে মঙ্গলবার রিভিউ আবেদনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া।
শুনানিকালে মওদুদ বলেন, ১৫ জন সাক্ষীর যে জবানবন্দী ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেছেন, সেখানে তাদের স্বাক্ষর নেই। রাষ্ট্রপক্ষের কৌশুলীদের যুক্তি হচ্ছে, সাক্ষীদের এখানে আনা ব্যয়বহুল। তাদের যুক্তি যদি এটা হয়, তাহলে তা হবে বেআইনি ও অন্যায়।
মওদুদ পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সব সময়েই বলে এসেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা চাই। তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, আইনানুযায়ী ও আন্তর্জাতিক মানের।
কিন্তু বিবাদীদের যদি সাক্ষীকে ক্রস একজামিন (জেরা) করতে না দেওয়া হয়, তাহলে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্যেও কোনো মূল্য নেই। ক্রস একজামিন একজন বিবাদীর মৌলিক অধিকার।
তিনি বলেন, ‘যাদের জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের যদি জেরা না করা যায়, আর সেই সাক্ষীর ভিত্তিতে যদি অভিযুক্তের বিচার হয় তবে সে রায় হবে বেআইনি, অন্যায়, অসাংবিধানিক ও অভিযুক্তের প্রতি অবিচার। কোনো ভাবে সেখানে আমরা ন্যায় বিচার ও সুবিচার পাবো না।’
তাহলে কি স্বচ্ছ বিচার হচ্ছে না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেন, ‘ক্রস একজামিন না হলে সে বিচার স্বচ্ছ হবে না বলেই আমরা মনে করি।’
এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টিভির দুটি রিপোর্ট প্রদর্শন করা হয়। সেখানে ঊষারানী মালাকার, চান মিয়া পসারি, গণেশ চন্দ্র সাহা, ও সুখ রঞ্জন বালি সাঈদীর বিরুদ্ধে এ ৪ জন সাক্ষীর সাক্ষাতকার প্রচারিত রিপোর্ট প্রদর্শন করা হয়।
সেখানে তারা বলেছেন, ‘আমাদের কাছে কেউ আসে নাই। সাক্ষ্য দেই নাই। এ বিষয়ে কিছু জানি না।’
এ বিষয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের মতো করে তাদের জবানবন্দী তৈরি করেছেন।
মঙ্গলবার মানিক পসারি, মধুসদন ঘরামীসহ রাষ্ট্রপক্ষের তিন সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার জন্য রিকল আবেদনও করে আসামিপক্ষ।
গত ২৯ মার্চ সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকতাদের কাছে দেওয়া ৪৬ সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই ১৫ জন হলেন-উষা রানী মালাকার (৭৮), সুখরঞ্জন বালি (৫৭), আশীষ কুমার মণ্ডল (৫৫), সুমতি রানী মন্ডল (৫৮), সমর মিস্ত্রী (৫৭), সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল (৭০), গনেশ চন্দ্র সাহা (৪৫), শহিদুল ইসলাম খান সেলিম (৫৫), মো. মোস্তফা (৫০), আব্দুল লতিফ হাওলাদার (৬২), আইয়ুব আলী হাওলাদার (৬২), সেতারা বেগম (৭৫), অনিল চন্দ্র মণ্ডল (৭৬), রানী বেগম (৫২) ও অজিত কুমার শীল (৭৫)।
সাঈদীর বিরুদ্ধে মোট ১৩২ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রত্যক্ষ সাক্ষী ৬৮ জন। তাদের মধ্যে ২৭ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর দায়ের করা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে তার রাজধানীর শাহীদবাগের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর তাকে ২ আগস্ট মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
শুনানি শেষে সাঈদীর বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ জুলাই আনা অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল। ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৯ নভেম্বর থেকে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মামলার সাক্ষীরা।
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগ এবং ৭৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয় জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং একশ’ থেকে দেড়শ’ হিন্দুকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে।