আইনি সহায়তার অভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও কেন্দ্রের উদাসীনতায় দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন বিএনপির অনেক পরীক্ষিত নেতা-কর্মী। এদের অনেকেই রাজনীতি থেকে সরে যার যার ব্যবসা-বাণিজ্য, পেশা বা পারিবারিক কাজে মনোযোগী হয়ে উঠছেন।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘বিএনপি করার কারণে গত সাড়ে তিন বছরে সারাদেশে লক্ষাধিক পরীক্ষিত নেতা-কর্মী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তারওপর রয়েছে মামলার জুজু।’
তিনি জানান, এদের কেউ কেউ দায়সারাভাবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিলেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতা-কর্মীর সংখ্য নেহায়েত কম নয়। জেল-জুলুম আর মামলার ভয়ই তাদের দলীয় কর্মসূচি থেকে সরিয়ে রাখছে। এ কারণেই বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের সভা-সমাবেশে দিন দিন কর্মী উপস্থিতি কমছে।
সর্বশেষ ছয়টি হরতালে মামলার খাঁড়ায় যেন আরো বিক্ষত হয়েছে বিএনপি। গত ২২ ,২৩, ২৪, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল এবং ১৭ মে বিএনপিসহ ১৮ দলের ডাকা হরতালে সারা দেশে বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ছয় হরতালে পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার হয়েছেন সহস্রাধিক নেতা-কর্মী।
এর মধ্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় ৪৫ নেতাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় ও কাশিমপুর কারাগারের হাই সিকিউরিটি সেলে রাখা হয়েছে তাদের।
এ সব কেন্দ্রীয় নেতার জামিনের জন্য উচ্চ ও নিম্ন আদালতে শত শত আইনজীবী পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিন্তু গত ৬টি হরতালে ঢাকার থানা ও ওয়ার্ডসহ সারাদেশের জেলা-থানায় আটক হওয়া নেতা-কর্মীদের পাশে কেন্দ্র বা কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা দাঁড়ায়নি বলে ঢালাও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে পদ খোয়ানো ও দল থেকে বহিষ্কারের ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না এসব ভুক্তভোগী।
কয়েকজন নিযাতিত কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে. তারা দলীয়ভাবে কোন সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তবে এ ব্যাপারে মিডিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিক কোন কথা বলতেও নারাজ তারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের রোষাণলে পড়ে আরো বড় কোন ক্ষতির আশঙ্কাই তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে।
এ অসহায় অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধারের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেওয়া উদ্যোগও কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০১১ সালের প্রথম দিকে নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামকে নির্দেশ দেন তিনি। একইভাবে আর্থিকভাবে অসচ্ছল নেতা-কর্মীদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করার জন্যও কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেন বিএনপি প্রধান।
দলীয় প্রধানের নির্দেশে নেতা-কর্মীদের আইনি সহযোগিতার জন্য একটি লিগ্যাল এইড কমিটিও করে দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ কমিটির আহবায়ক ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। সদস্য সচিব ছিলেন ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ছানাউল্লাহ মিয়া।
দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মধ্যে নানা গুপিং থাকায় আহবায়ক কমিটির পক্ষে কমিটিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে ওই কমিটি আলোচনা থেকেই হারিয়ে যায়।
তবে এ ব্যাপারে লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট ছানাউল্লাহ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিপদগ্রস্ত নেতাদের পাশে আইনজীবীরা নেই- এ কথা ঠিক না। তবে নানা কারণে আমরা লিগ্যাল এইড কমিটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারিনি।’
তবে জাতীয়তাবাদী ফোরামের আইনজীবীরা যাই বলুক না কেন মিডিয়ার নজর কাড়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিহত ও আহত কর্মীদের বাড়িতে যান নেতারা। পরে আর ওইসব পরিবারের কোন খোঁজই রাখেন না তারা।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারির গণমিছিলে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও রাজশাহীতে চার জন কর্মী নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিহতদের কোন কোন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে শান্ত্বনা দেন। এরপর গত সাড়ে তিন মাসে তাদের আর কোন খোঁজই রাখেননি কোন কেন্দ্রীয় নেতা।
২০১০ সালের ৭ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ছানাউল্লাহ নূর বাবু প্রতিপক্ষের হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন। তার পরিবারকে শান্ত্বনা দিতে বড়াইগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খালেদা জিয়া। বাবু নিহত হওয়ার তিনদিন পর বড়াইগ্রাম যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জে খালেদা জিয়ার জনসভা আয়োজন করা হয়। ওই জনসভায় আসার পথে সায়দাবাদ ট্রেনে কাটা পড়ে ৫ বিএনপি কর্মী নিহত হন। ওই দিন রাতেই খালেদা জিয়া নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুর পরিবারকে শান্ত্বনা দিতে বড়াইগ্রাম যান। এর পর আর সিরাজগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহতদের ও নিহত বাবুর পরিবারের কোন খোঁজই কেউ রাখেননি। খোঁজ নেননি সিরাজগঞ্জে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আসামি হওয়া শত শত নেতা-কর্মীর। এদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। এমনকি মামলা-মোকদ্দমায় অনেকে পথেও বসেছেন।
এসব ঘটনায় অনেকটা আক্ষেপ করেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মানিকগঞ্জের এক যুবদল নেতা বাংলানিউজকে জানান, রাজনীতি করার কারণে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। জেল-জুলুম আর পুলিশি হয়রানির কারণে তার সুখের সংসার শেষ হয়ে গেছে।
একইভাবে মামলার পর মামলায় গ্রেপ্তার ও জেল খাটতে খাটতে ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছেন ছাত্রদল নেতা ইয়াসিন সরকার।
গত ৭ মে গুম হন পাবনার সুজানগরের বিএনপি নেতা কালাম মুন্সী। তার আগে সিলেটের ছাত্রদল নেতা দিনার। আরো আগে নিখোঁজ হন ঢাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। যশোরের বিএনপি নেতা নাজমুল ইসলামের লাশ উদ্ধার হয় গাজীপুর থেকে।
তাদের পরিবারের খোঁজও এখন আর কেউই রাখছেন না। তাই নির্যাতিতদের দল থেকে হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
এ ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘দলীয়ভাবে নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ রয়েছে কেন্দ্র থেকে। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা নির্যাতিতদের সহযোগিতার চেষ্টা করছে। তবে বিএনপি একটি বড় দল। এ দলের অনেক নেতা-কর্মী। তাই যাদের আইনি সহযোগিতা দরকার তাদের আমাদের কাছে আসতে হবে। আমরা তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইনি সহযোগিতা দিতে পারবো না।’