গাড়ি আমদানির রাজস্বেই ফ্লাইওভার নির্মাণ সম্ভব: হাবিবউল্লাহ ডন

গাড়ি আমদানির রাজস্বেই ফ্লাইওভার নির্মাণ সম্ভব: হাবিবউল্লাহ ডন

নতুন অর্থ বছরের বাজেট আসছে। কিন্তু সে বাজেটে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানীকারকদের জন্য কী কোনো সুসংবাদ থাকছে? এ নিয়ে উদ্বিগ্ন আমদানীকারকরা। দুই বছর ধরে টানা লোকসান টানছেন, ব্যাংকঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন অনেকে। ছোট বিনিয়োগকারীরা অনেকাংশেই ব্যবসা হারিয়েছেন। মাঝারি গোছেররা ধুকে ধুকে টিকে আছেন। যারা একটু বড় মাপের ব্যবসায়ী তারা বিপুল লোকসান দিয়েও টিকিয়ে রাখছেন ব্যবসা। তাদের হিসেবে গত এক বছরে ৬০ শতাংশ ব্যবসা হাতছাড়া হয়েছে তাদের।

রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানীকারকদের অভিযোগ ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে গাড়ি আমদানিতে সর্বোচ্চ ৮২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কারণেই তা অধিকাংশের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

পাশাপাশি ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি আমদানিকারকরা ‘অসাধু উপায়ে’ লো-ইনভয়েসের মাধ্যমে গাড়ি এনে কমদামে বাজারে ছাড়ার কারণে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারকরা।

তাদের দাবি, স্রেফ এ কারণে বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিলো দেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে ট্রেন্ড সেটার নামে পরিচিত হাবিবউল্লাহ ডনের সঙ্গে। অটো মিউজিয়াম লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সভাপতি হাবিবউল্লাহ ডন আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘গত দুই বছরে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন।’

ডন বলেন, গাড়ি আমদানিতে ৮২৯ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্যের নজির পৃথিবীতে নেই। তিনি বলেন, “শুল্ক ধার্য করাই শেষ কথা নয়, তা সার্বিক অর্থনীতিতে কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটি অবশ্যই হিসেব কষে দেখতে হবে।”

“আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই অধিক হারে শুল্ক ধার্য করে সরকার গাড়ি আমদানি থেকে সম্ভাব্য রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এবারের বাজেটে আমরা এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না,” বলেন হাবিবউল্লাহ ডন।

গত চার বছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের একটি খতিয়ান তুলে ধরেন এই অ্যাওয়ার্ডজয়ী গাড়ি ব্যবসায়ী। তিনি জানান, ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরগুলোতে সরকার এই খাতে তিন হাজার কোটি টাকা করে রাজস্ব আয় করলেও ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে তা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।

গাড়ি আমদানিতে অধিকহারে শুল্ক আরোপ করে সরকার কী এই ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করতে চায়? এমন প্রশ্ন তুলে হাবিবউল্লাহ ডন বলেন, প্রাইভেট কার এখন অনেকেরই ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অথবা অনেক বেশি দরে গাড়ি কিনতে হচ্ছে। নাগরিকবান্ধব কোনো সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকার পাবলিক ভেহিকল নিশ্চিত করতে পারছে না। আবার মানুষ নিজস্ব পরিবহন কিনে নিয়ে তাতে চড়বে তাও ব্যাহত করছে।”

তিনি বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্তটি ‘মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলা’র মতোই হয়েছে। কারণ রাস্তায় যানজটের পেছনে ফুটপাথ দখল, রাস্তার ওপর দোকানপাট বসানো, যেখানে সেখানে রাস্তা দখল করে নির্মাণ কাজ, গাড়ি চালকদের ইচ্ছামতো পার্কিং, যাত্রী ওঠানো-নামানো এসবই প্রধান কারণ। এগুলোর সমাধান না করে সরকার রাস্তায় গাড়ি কমাতে গাড়ি আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে প্রয়োজন থাকলেও সামর্থের বাইরে চলে যাওয়ায় অনেকেই গাড়ি কিনতে পারছেন না।”

হাবিবউল্লাহ ডন আরও বলেন, “সরকার পর্যাপ্ত পাবলিক ভেহিকল নিশ্চিত করতে পারছে না, রাস্তা প্রশস্ত করতে পারছে না, পর্যাপ্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে পারছে না। সেগুলো করা হলে ঢাকার রাস্তায় লোক চলাচলে আরো অনেক গাড়ির প্রয়োজন হবে।”

একটি প্রাইভেট কার যে সুবিধা নিশ্চিত করে পাবলিক বাস তা করতে পারবে এমনটাও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না, বলেন হাবিবউল্লাহ।

রাজধানীর গুলশানে অটো মিউজিয়ামের শো রুমে বসে আরও বিস্তারিত কথা হয় হাবিবউল্লাহ ডনের সঙ্গে।

তিনি এসময় সরকারের বিরুদ্ধে দ্বৈত বা বৈষম্যমূলক নীতির অভিযোগ এনে বলেন, “ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য বেশি সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া যারা এই গাড়ি আমদানি করছেন তারা লো-ইনভয়েস করে সরকারকে বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন।”

একেকটি গাড়িতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কম ইনভয়েস করা হয় বলে অভিযোগ করেন হাবিবউল্লাহ ডন। তিনি বলেন, “একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে কাজ করছে। রপ্তানিকারক দেশগুলোর কিছু অসাধু রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশের কিছু অসাধু আমদানিকারক এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।”

হাবিবউল্লাহ জানান, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করতে জাপান অটো অ্যাপ্রাইজাল ইনস্টিটিউট  (জেএএআই) প্রকাশিত ইয়ালো বুকের মূল্যকে শুল্কায়নের ভিত্তি ধরা হয়। কিন্তু নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে এ ধরনের গ্রহণযোগ্য কোনো ভিত্তি অনুসরন করা হয় না।

নতুন গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ডিলারের ঘোষিত মূল্যকে শুল্কায়নের ভিত্তি ধরা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে জালিয়াতির একটি সুযোগ রয়েছে যা বরাররই এড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারের নীতিতে উৎপাদনকারীর নিয়োজিত ডিলারদের মাধ্যমে গাড়ি আনা এবং সে অনুযায়ী গাড়ির শুল্ক নির্ধারণ করার কথা থাকলেও নতুন গাড়ির আমদানিকারকরা তা মানছেন না। এ ধরনের ডিলারের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই কম হওয়ায় তৃতীয় কোনো কোম্পানির মাধ্যমে ইনভয়েস করিয়ে গাড়ি আনাকেও সরকার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।”

হাবিবউল্লাহ ডন বলেন, “ঠিক এখানেই সরকারকে প্রতারণা করার সুযোগ নিচ্ছেন আমদানিকারকরা। তারা তৃতীয় পার্টির কাছ থেকে কমমূল্যের ইনভয়েস করিয়ে বিশাল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। আর সে কারণে বাজারে তারা কম দরে গাড়ি বিক্রি করতে পারছেন।”

হাবিবউল্লাহ বলেন, “এর ফলে সৃষ্ট গ্যাপের কারণে মার খাচ্ছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজার।”

তিনি বলেন, “মাত্র দুই বছর আগেও দেশের মোট গাড়ির চাহিদার ৯০ শতাংশ গাড়ি সরবরাহ করতেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারকরা। যা বর্তমানে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।”

হাবিবউল্লাহ ডন বলেন, “আমরা সরকারের কাছে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি করছি। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে সুনির্দিষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মাননীয় অর্থমন্ত্রী বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং সমন্বয় করা হবে বলে কথা দিয়েছেন।”

হাবিবউল্লাহ বলেন, আমরা এখন বাজেটে বিষয়টি কিভাবে আসে তার অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি বলেন, “এবারেও যদি বাজেটে বিপুল অঙ্কের শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয় তাহলে অনেক ব্যবসায়ীকে পথে বসতে হবে। তবে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ক্রেতা সাধারণের। গাড়ি তাদের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যাবে।”
auto-musium
হাবিবউল্লাহ ডন বলেন, “দেশের অর্থনীতির চাকার সঙ্গে গাড়ির চাকাও একটি বড় বিবেচ্য। গতিশীল মানুষ কাজ করেই অর্থনীতিকে গতিশীল করবে। সেক্ষেত্রে গাড়ি না থাকলে মানুষের চলাচলে যে স্থবিরতা বা বিঘ্ন ঘটবে তা অর্থনীতিরই ক্ষতির কারণ হবে।”

২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে গাড়ি মোটরযানের ওপর শুল্ক নির্ধারনে সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি (সিসি)ভিত্তিক যে বিন্যাস করা হয়েছে তাও পুনর্বিন্যাসের দাবি জানিয়েছেন সাবেক এই বারবিডা প্রধান।

তিনি বলেন, “মাইক্রোবাসে সিসি ভেদে ৩০ ও ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধরা হয়েছে। যা পুরোপুরি অযৌক্তিক।”

মাইক্রোবাস বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্স, রেন্ট-এ-কার, স্কুল বাস, অফিস বাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে এ গাড়ির ওপর থেকে সরকারের শুল্ক প্রত্যাহার করা উচিত বলেই মত দেন হাবিবউল্লাহ ডন।

তিনি জানান, বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নজরে আনলে তিনি বলেছেন, বিবেচনা করে দেখবেন।

হাবিবউল্লাহ ডন বাংলানিউজকে বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট যাতে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব তথা সরকারের রাজস্ববান্ধব হয় সেটিই নিশ্চিত করতে হবে।

অধিক গাড়ি রাজধানীতে অধিক যানজটের সৃষ্টি করবে এমন প্রসঙ্গে হাবিবউল্লাহ বলেন, বেশি বেশি ফ্লাইওভার করা হলে, পাতাল রেল করা হলে যানজট থাকবে না।

তিনি বলেন, “কেবল গাড়ি আমদানিকারকদের দেওয়া রাজস্বের বাৎসরিক তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ সম্ভব। এ জন্য সরকারকে ঋণ করতেও হয় না।”

রিকন্ডিশন্ড জাপানি গাড়ি পরিবেশ বান্ধব বলে, তা ঢাকারসহ গোটা দেশের সড়ককে দুষণমুক্ত রাখবে এমন মত দেন এই সফল গাড়ি ব্যবসায়ী।

১৯৯১ সাল থেকে রিকন্ডিশন্ড ও ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি আমদানি করে দেশের গাড়ির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন হাবিবউল্লাহ ডন।

অর্থ বাণিজ্য