অধ্যায়ের বর্ণিল অংশটি শেষ হয়েছে বেশ আগে। এরপর কেটে গেছে ২৯ বছর। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ ও তাঁর দল কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। গুরুত্বের এই হিসাবটি ছিল ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আজ তারও অবসান হলো। আজ রবিবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন এরশাদ।
এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন জন্ম শহরেই। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫০ সালে সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন এরশাদ। তিনি ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। পরে পালন করেন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়োগ দেন তৎকালীন সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ সময় এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে নিযুক্ত হন চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপরই রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ পেতে থাকে এরশাদের। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে আবির্ভুত হন। ওইদিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এফ এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। যদিও বিচারপতি চৌধুরীর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব রাখেননি এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসনের পর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে এ পদেই বসে যান।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন এরশাদ। নবগঠিত এ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তিনি, মহাসচিব নিযুক্ত করেন অধ্যাপক এম এ মতিনকে। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন এরশাদ। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে এরশাদ তার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এ পদে নির্বাচিত হওয়ার পর সে বছরের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহ্বান করেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাশ করে সেদিন জাতীয় সংসদ সংবিধান পুনর্বহাল করে। তবে বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর এরশাদ ফের সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। প্রধান বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে।
এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে এবং প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সালে গ্রেপ্তার হন এরশাদ। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে কারান্তরীণ অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। তৎকালীন সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলা করে। এর কোনো কোনোটিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর কারাভোগের পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তার আসন বাতিল হয়ে যায়। ২০০০ সালে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশই টিকে যায়।
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-আসা পর্যন্ত কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর আবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার তিনি চেয়ারম্যান।
২০০১ সালের অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। এরপর তিনি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর অনুষ্ঠিত দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন পেয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকেছে তাঁর দল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনে তার সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হন।
শারীরিক অসুস্থতার দরুন ২০১৯ সালের ২৭ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এরশাদকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। তিনি রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন।