তেল পাচারের নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট, তদন্তে র‌্যাব মাঠে

তেল পাচারের নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট, তদন্তে র‌্যাব মাঠে

বন্দর নগরী চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে ফার্নেস অয়েল পাচারের নেপথ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত বিভিন্ন বিদেশি জাহাজে জ্বালানি তেল বাঙ্কারিং (সরবরাহ) বন্ধ থাকার  সুযোগকে ব্যবহার করে চিহ্নিত সিন্ডিকেটটি অবৈধভাবে হাজার হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল পাচার করছে। এতে সরকার প্রতিবছর প্রায় পাঁচ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশিষ্টরা।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, যমুনা অয়েল কোম্পানি বিদেশি জাহাজে জ্বালানি সরবরাহের জন্য সরকার অনুমোদিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান। তবে গত দেড় বছর ধরে যমুনা অয়েল থেকে নিয়মিতভাবে বিদেশি জাহাজে জ্বালানি তেল (ফার্নেস অয়েল) বাঙ্কারিং করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে গত জানুয়ারিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক উপ-সচিব তদন্ত করে যমুনা অয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেন। কিন্তু ওই রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর পাঁচ মাসেও তার কার্যকর প্রয়োগ হয়নি।

গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর আনু মাঝির ঘাট এলাকায় এক লাখ চার হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল  পাচারের সময় র‌্যাব-৭ এর একটি দল ১১টি ভাউচার (তেল লরি) জব্দ করে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২৩ জনকে আটক করে র‌্যাব।

রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল অয়েল কোম্পানির চট্টগ্রামের পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে ডেলিভারি নেওয়ার পর অবৈধভাবে বিদেশি জাহাজে সরবরাহের আগ মুহূর্তে র‌্যাবের টিমটি ১১টি ভাউচার ভর্তি প্রায় এক লাখ চার হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল আটক করে। আটককৃত ফার্নেল অয়েলের মূল্য প্রায় ৬২ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। আটককৃত সকলেই ভাউচারের চালক ও সহকারি।

বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিভিন্ন তেল কোম্পানির বিপণন বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একটি চক্র নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল এবং বিটুমিনের ডেলিভারি অর্ডার ইস্যু করিয়ে নিচ্ছে। সরকার এমনিতে প্রতি বছর জ্বালানি তেলের জন্য প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ এসব জ্বালানি তেল অসাধু চক্রটি নির্বিঘেœ পাচার করে চলেছে।

প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, গত রোববার ১৬টি কম্পানির নামে পদ্মা অয়েলের পতেঙ্গা ডিপো থেকে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে ১৩টি ডিও ইস্যু করেন ডিপোর ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) আসিফ মালেক। বাকি তিনটি ইস্যু করেন মফিজুর রহমান নামের অপর এক ব্যবস্থাপক। ডিও ইস্যু হওয়া কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই নামসর্বস্ব বলে অভিযোগ উঠেছে।

ফার্নেস অয়েল ডিও ইস্যু করার সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমতি প্রয়োজন হলেও ডিপোর কর্মকর্তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো ডিও ইস্যু করে থাকেন বলে পদ্মা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান।

রোববার ডিও ইস্যু করা এসব কোম্পানিগুলো হলো- মেসার্স এন আলম স্টিল মিল চট্টগ্রাম, ঠা-াছড়ি চা বাগান রাঙ্গুনিয়া, ডেল্টা জুট মিল নোয়াখালী, ওমর সুলতান ডাইং এন্ড স্পিনিং চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিল লিঃ চট্টগ্রাম, পেসিফিক স্টিল মিল- মোহরা চট্টগ্রাম, নায়েক স্টিল মিল চট্টগ্রাম, রূপালী কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ সাগরিকা রোড় চট্টগ্রাম, মোতালেব স্টিল মিল চট্টগ্রাম, যমুনা ফার্টিলাইজার এন্ড অ্যাগ্রো কেমিক্যাল চান্দপুর, এ কে স্টিল লিঃ কুমিরা চট্টগ্রাম, আমান স্টিল রি-রোলিং মিল চট্টগ্রাম,  আজিজ উদ্দিন ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ চট্টগ্রাম, মেসার্স সাবাব রি-রোলিং মিল লিঃ চট্টগ্রাম এবং মেসার্স ম্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ চট্টগ্রাম। এভাবে প্রতিদিন নাম সর্বস্ব কোম্পানির নামে জ্বালানি তেলের ডিও ইস্যু করা হয়।

এদিকে, র‌্যাব-৭ এর কর্মকর্তারা জ্বালানি তেল পাচারের ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে। র‌্যাব বিভিন্ন তেল কোম্পানিগুলোর নিবন্ধিত জ্বালানি তেলের গ্রাহক ও ডিলারদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে। এছাড়া যেসব কোম্পানির নামে বার বার জ্বালানি তেল ডেলিভারি অর্ডার ইস্যু হচ্ছে এসব বিষয়েও খোঁজ খবর নিচ্ছে র‌্যাব।

র‌্যাবের টিম মঙ্গলবার চট্টগ্রামে বাংলাদেশ পেট্রেলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানির বিপণনের বিষয়ে খোঁজ খবর নেন।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-৭ এর উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউল আহসান সরওয়ার পদ্মা অয়েল কোম্পানির বিপণনের  কাগজপত্র  খতিয়ে দেখার বিষয়টি স্বীকার করেন।

সূত্র জানায়, পদ্মা অয়েল কোম্পানি গত ১০ মাসে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল বিপণন করেছে। পাশাপাশি একই সময়ে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কম্পানি বিপণন করেছে মাত্র ১৮ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল।

এ প্রসঙ্গে পদ্মা অয়েল কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কোম্পানির কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

বাংলাদেশ