অবৈধ পথে ভারত থেকে আসা শাঁখায় সয়লাব দেশি শাঁখার বাজার। এতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশি শঙ্খশিল্প। বেকার হয়ে পড়ছেন শাঁখা কারিগর, নকশাশিল্পীসহ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। মারাত্মক জীবিকার সংকটে এসব পরিবারগুলো। ফলে বাধ্য হয়েই বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন অনেকে।
ভারত থেকে চোরাই পথে শাঁখা আনায় যেমন বিঘ্নিত দেশি এ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা, তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের অর্থনীতিও ।
সম্প্রতি দেশের শঙ্খশিল্পের সূতিকারগার রাজধানীর বিখ্যাত শাঁখারিবাজারে ঘুরে জানা গেছে, এ শিল্পের চলমান এসব দুরবস্থা। কেবল শাঁখারিবাজারেই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় শঙ্খশিল্পের বাজারগুলোতেও খোঁজ নিয়েও জানা গেছে একই চিত্র।
মোমবাতি-আগরবাতি বেঁচেন কারিগরেরা!
পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারের শাঁখা কারিগর প্রাণকৃষ্ণ নন্দী। এক সময় সারাদিন কাজের চাপে খাওয়ারও সময় পেতেন না। শাঁখা বিক্রেতাদের অর্ডারের মাল সময় মতো সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। এখন দিন কাটে বসে থেকে। ব্যস্ত কারিগর প্রাণকৃষ্ণ এখন শাখারিবাজারেই আগরবাতি আর মোমবাতি বেঁচে কোনো রকমে সংসার চালান।
তিনি বলেন, ‘আগে শ্রীলঙ্কা থাইক্যা কাঁচামাল আইতো। হাতে কাটা করাত দিয়া আমরা এখানেই বানাইতাম শাঁখা ও অন্যান্য জিনিস। আর এ্যাহন মাদ্রাজের বাতিল মাল আঠা লাগাইয়া পাবলিকগো বেঁচবার লাগছে। দুই দিন পরেই ভাইঙ্গা যায় এ শাঁখা। কাস্টমারগোর লগে এ লইয়া প্রায়ই বিবাদ বাধে।’
আরেক কারিগর শম্ভুনাথ ধর। জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন শাঁখা তৈরির কাজ করে। তিনিও এ শিল্পের বর্তমান চলমান দুরবস্থার নানা কথা তুলে ধরেন।
শাঁখারিবাজারের শাঁখাশিল্প বহু প্রাচীন হলেও শঙ্খশিল্পী কারিগর সমিতির গোড়াপত্তন হয় ১৯৮৭ সালে। আগে হাতে কাটা করাত দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে শাঁখা ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি হলেও সমিতি গড়ে ওঠার পর শাঁখারিবাজারে পরিবর্তন আসে।
কারিগরেরা সমিতির অফিসে করাত জমা দিয়ে মেশিনে শাঁখা তৈরি শুরু করেন। আগে ৭০-৮০ জন কারিগর কাজ করলেও মেশিন আসার পর এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৫-২০ জনে। এখানকার কারিগরেরা আগে প্রতিদিন এক হাজার জোড়া শাঁখা ও পলা সারাদেশে সরবরাহ করতেন। এখন এর দ্বিগুণ শাঁখা বিক্রি হলেও প্রায় সবটাই আনা হচ্ছে ভারত থেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেই এসব শাঁখা ও এ জাতীয় অন্যান্য সামগ্রী আনা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শঙ্খ কারিগর অভিযোগ করেন, ভারতের যেসব শাঁখা ফাটা, ভাঙ্গা ও বিক্রির অযোগ্য, সেগুলোই জোড়া লাগিয়ে বাংলাদেশে বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে। যেসব ব্যবসায়ী মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত তারাই মূলত: চোরাই পথে ভারত থেকে শাঁখা এনে দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ইতিপূর্বে কুরিয়ার সার্ভিসে ভারত থেকে শাঁখার সঙ্গে মাদক আনার সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে বলেও কারিগররা জানান।
প্রতি মাসে কমপক্ষে কোটি টাকার শাঁখা ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই জনসমক্ষেই অবৈধ পথে আনা ভারতীয় শাঁখা বিক্রি করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কেউ এসব বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ শঙ্খ কারিগরদের।
এক সময়ের সদা ব্যস্ত শঙ্খ কারিগর সমিতির অফিসটিতেও বর্তমানে নেই কোনো ব্যস্ততা। কাজ না থাকলেও কয়েকজন বসেই সারাদিন পার করে দেন এখানে। সব সময় ঘুরতে থাকা শঙ্খ কাটার মেশিনটিও অব্যবহৃত থাকতে থাকতে মরচে ধরে অকেজো হওয়ার প্রতীক্ষায়।
কারিগররা জানান, ব্যবসায়ী ও শঙ্খশিল্পী মিলে শঙ্খশিল্পী কারিগর সমিতির ১৭৫ জন সদস্য থাকলেও ভারত থেকে নিন্মমানের শাঁখা আনা শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীরা আর সমিতি ও কারিগরদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখছেন না।
শঙ্খশিল্পী কারিগর সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভোলানাথ শূর, বর্তমানে নিজেও ভারত থেকে শাঁখা এনে ব্যবসা করছেন। তাই খুব বেশি আসেন না সমিতির অফিসে। এ বিষয়ে জানতে টেলিফোনে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
শাঁখারিবাজারের শাঁখা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মা মনসা, শূর প্রোডাকশন ইত্যাদি দোকানে গিয়ে ভারতীয় শাঁখা বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে বিক্রি করা শাঁখা কোথাকার জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে চাননি এসব ব্যবসায়ীরা।
শাঁখারিবাজারের প্রায় দোকানিই সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে অন্যজনকে দেখিয়ে দেন এসব বিষয়ে কথা বলতে।
আদিকথা
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের অলঙ্কার ও ধর্মীয় উপাসনার উপকরণ হিসেবে শাঁখার ব্যবহার অতি প্রাচীন। বহু ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন শঙ্খশিল্পের আদি ইতিহাস ।
বাংলাপিডিয়ার সংকলক শিপ্রা সরকার উল্লেখ করেছেন, ‘দাক্ষিণাত্যে প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকেই এ শিল্পের প্রচলন ছিল বলে জানা গেছে। তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই এবং কায়েলের ভগ্নস্তুপ থেকে শঙ্খশিল্পের প্রাচীন নির্দশন আবিষ্কৃত হয়েছে।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘মাদ্রাজ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত শঙ্খশিল্পের নিদর্শন দেখে জেমস হরনেল বলেন যে, খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতকেই মহীশূর, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কাথিয়াবার প্রভৃতি অঞ্চলে শঙ্খশিল্পের বিকাশ লাভ করেছিল। এর পরেই শঙ্খশিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এবং ক্রমে ঢাকাই হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র।
ঢাকায় বল্লাল সেনের (১২শ শতক) আমল থেকে শঙ্খশিল্পের প্রচলন হয় বলে অনুমাণ করা হয়।
শাঁখারি সম্প্রদায় প্রথমে বিক্রমপুরে বসতি স্থাপন করে। সতেরো শতকে মুগলরা ঢাকায় এলে শাঁখারিদের এখানে আনা হয়। তারা ব্যবসায়ের উপযুক্ত একটি এলাকা নির্ধারণ করে বসতি স্থাপন করেন, যার বর্তমান নাম শাঁখারিবাজার।’
দামদর
শাঁখারিবাজারে ভিন্ন ভিন্ন দাম ও ডিজাইনের শাঁখা বিক্রি হয়। এর মধ্যে সাধারণ শাঁখা ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০-১২০০ টাকার মধ্যে। নকশা করা শাঁখা ১৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত। নকশা করা শাঁখার মধ্যে ময়ূরমুখ শাঁখা, হাঁসমুখ শাখা, মকরমুখ শাঁখা বেশি আকর্ষণীয় ও চাহিদা সম্পন্ন।
শঙ্খশিল্পের মূল উপকরণএকাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক শঙ্খ। এগুলোর অন্যতম উৎসস্থল শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের মাদ্রাজ।
শাঁখা ও শঙ্খজাত অলঙ্কার তৈরির জন্য ব্যবহৃত শঙ্খের মধ্যে তিতপুটি, রামেশ্বরি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, রায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, ঝাঁজি, দোয়ানি, জাডকি, কেলাকর, তিতকৌড়ি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপাটি, আলাবিলা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের এবং আলাবিলকে নিন্মমানের শঙ্খ ।
হাতের শাঁখার মধ্যেও বিভিন্ন নামের শাঁখা রয়েছে। এর মধ্যে সাতকানা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী উল্লেখযোগ্য। সৌখিনদের জন্য রয়েছে সোনা বাঁধাই শাঁখা।
এসবের মধ্যে টালি, চিত্তরঞ্জন, সতীলক্ষী, জালফাঁস, লতাবালা, মোটলতা, তাঁরপেচ ইত্যাদি। বিবাহিত হিন্দু নারীরাই মূলতঃ এসব শাঁখা ব্যবহার করলেও শখের বশে অন্য ধর্মের নারীরাও কদাচিৎ শাঁখা পরে করে থাকেন।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী থেকে শাঁখারিবাজারে সস্ত্রীক শাঁখা কিনতে এসেছিলেন খিলগাঁও গভ. স্কুলের গণিত শিক্ষক মৃদুল রায়। আধুনিক যুগে বিচিত্র সব অলঙ্কারের মাঝেও কেন শাঁখা-এমন প্রশ্নের জবাবে তার স্ত্রী মানসী রায় বলেন, ‘মূলতঃ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই হিন্দু বিবাহিত নারীরা শাঁখা ব্যবহার করেন। এটা পড়লে স্বামীর অমঙ্গল হবে না, এমনটাই আমরা বিশ্বাস করি।’
শঙ্খের বিচিত্র ব্যবহার
শঙ্খ কেবল শাঁখা তৈরির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় না। এর রয়েছে বিচিত্র ব্যবহারও। হাতের শাঁখা ছাড়াও শঙ্খের তৈরি ব্রেসলেট, ব্রুশ, ব্যাংগেল, ঘড়ির চেন, চুলের ক্লিপ, খোঁপার কাঁটা, শঙ্খের মালা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে শঙ্খের পেপারওয়েট, সেপটিপিন, আতরদানি, ফুলদানি, এসট্রের ব্যবহারও লক্ষণীয়।
বড় আকৃতির এক প্রকারের শঙ্খ হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও পানির সংমিশ্রণে উজ্জ্বল করে এর বহিরাবরণে নকশা এঁকে তৈরি করা হয় জলশঙ্খ। হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানে জলশঙ্খে গঙ্গার পবিত্রজল রাখা হয়।
অন্য এক ধরনের শঙ্খ ব্যবহৃত হয় পূজা ও অন্যান্য হিন্দু আচার অনুষ্ঠানে মঙ্গলধ্বনি করার ক্ষেত্রে।