শেখ হাসিনার ট্রেনবহরে হামলা, ৯ জনের ফাঁসির রায়

শেখ হাসিনার ট্রেনবহরে হামলা, ৯ জনের ফাঁসির রায়

পাবনার ঈশ্বরদীতে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ট্রেনবহরে হামলার ঘটনায় করা মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় ২৫ জনের যাবজ্জীবন ও ১৩ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. রুস্তম আলী এ রায় দেন।

রায় ঘোষণার পর দণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারে পাঠানো হয়। এ মামলায় ৫২ জন আসামির মধ্যে একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তসহ ১৪ জন এখনও পলাতক রয়েছেন এবং পাঁচজন বিভিন্ন সময় মৃত্যুবরণ করেছেন। আসামিরা সবাই ঈশ্বরদী উপজেলা, পৌর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি একেএম আক্তারুজ্জামান (৬০), ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির বর্তমান সভাপতি ও তৎকালীন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু (৫০), ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মোখলেছুর রহমান বাবলু (৫৭), রেজাউল করিম শাহিন (৪৫), অটল (৪৫), আজিজুর রহমান ওরফে ফরিং শাহিন (৪৬), শ্যামল (৪০), মাহবুবুর রহমান ওরফে পলাশ (৪০) ও শামসুল আলম (৫৫)। এদের মধ্যে জাকারিয়া পিন্টু পলাতক রয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে তিন বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিন (পলাতক), আজাদ হোসেন ওরফে খোকন, ইসমাইল হোসেন জুয়েল, আলাউদ্দিন বিশ্বাস, শামসুর রহমান শিমু, আনিসুর রহমান ওরফে সেকম (পলাতক), আক্কেল আলী, রবি (পলাতক), এনাম, আবুল কাশেম ওরফে হালট কাশেম (পলাতক), কালাবাবু (পলাতক), মামুন (পলাতক), মামুন (পলাতক), সেলিম, কল্লোল, তুহিন, শাহ আলম লিটন, আব্দুল্লাহ আল মামুন রিপন, লাইজু (পলাতক), আব্দুল জব্বার, পলাশ, হাকিমুদ্দিন ওরফে টেনু, আলমগীর, আবুল কালাম (পলাতক) ও একেএম ফিরোজুল ইসলাম পায়েল। এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৩ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করার আদেশ দেয়া হয়।

১০ বছর করে কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- নেফাউর রহমান ওরফে রাজু, আজমল হোসেন ডাবলু, আনোয়ার হোসেন জনি, রনো (পলাতক), বরকত, চাঁদ আলী (পলাতক), এনামুল কবির, মুক্তা, হাফিজুর রহমান ওরফে মুকুল, হুমায়ন কবির ওরফে দুলাল (পলাতক), জামরুল (পলাতক), তুহিন বিন সিদ্দিক ও ফজলুর রহমান। এদেরকে একই সঙ্গে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।

পাবনা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান মুক্তা জানান, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা সাংগঠনিক সফরে খুলনা থেকে রাজশাহী অভিমুখে ট্রেনযোগে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ঈশ্বরদী স্টেশনে তার একটি নির্ধারিত পথ সভা ছিল। তাকে বহনকারী ট্রেনটি পাকশী স্টেশনে পৌঁছার পরপরই ওই ট্রেনে ব্যাপক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালানো হয়। ট্রেনটি ঈশ্বরদী এসে পৌঁছালেও একইভাবে বোমা ও গুলি বর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ঈশ্বরদী জিআরপি থানা পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই দিনই একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন সরকার। তারই অংশ হিসেবে ওই মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হলে আদালত তা গ্রহণ না করে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল ৫২ জনের বিরুদ্ধে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি পুলিশ। এ মামলায় সরকারপক্ষে ৩৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তিন দিন ধরে চলে যুক্তিতর্ক এবং গত সোমবার যুক্তিতর্ক শেষে আদালত ৩ জুলাই রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন।

এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরসহ পাবনা শহরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কড়া নিরাপত্তায় আসামিদের বেলা ১১টার মধ্যেই আদালতের হাজতখানায় নেয়া হয়। দুপুর পৌনে ১২টায় স্পেশাল ট্রাইবুনাল-৩ এর বিচারক মো. রুস্তম আলী এজলাসে বসেন এবং রায় ঘোষণা শুরু করেন। দুপুর ১২টায় রায় ঘোষণা শেষ হয়। এ সময় আদালতে সরকারপক্ষ এবং আসামিপক্ষের শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে থেকেই আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এবং আসামিদের স্বজনরা এসে ভিড় করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সর্দার আদালত চত্বরে আসেন। রায় ঘোষণার পর দণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আসামিদের আদালত থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজনকে উচ্চস্বরে বলতে শোনা যায়, আমাদের অন্যায়ভাবে দণ্ড দেয়া হয়েছে। আমরা এ রায় মানি না।

অন্যদিকে রায়ের পর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকমীরা আদালত চত্বরে অনন্দ মিছিল করেন এবং রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করেন। তারা অবিলম্বে রায় কার্যকরের দাবি জানান। আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরাও সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মিছিল করেন।

সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন ও পিপি আক্তারুজ্জামান মুক্তা। অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট ওবায়দুল হক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম পটল, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ কবির লিটন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সনৎ কুমার সরকার, অ্যাডভোকেট মাসুদ খন্দকার, মইনুল ইসলাম প্রমুখ।

সরকারপক্ষের আইনজীবী ও পিপি আক্তারুজ্জামান মুক্তা বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। ২৫ বছর ধরে পাবনাবাসী এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ খন্দকার বলেন, রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ। আমরা ন্যায় বিচার থেবে বঞ্চিত হয়েছি। গত ১ জুলাই যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। এত তড়িঘড়ি করে এত বড় একটি মামলার রায় দেয়া হলো যা অস্বাভাবিক। আমরা শিগগিরই উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর