ভারতে বেশিরভাগ পরিবারই নিজেদের ধর্ম ও জাত বা বর্ণের মধ্যেই বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক গড়তে পছন্দ করেন।
নিজের ধর্ম, জাত বা বর্ণের বাইরে গিয়ে বিয়ে করার পরিণাম অনেক সময় ভয়ংকর বা সহিংস হয়ে ওঠারও উদাহরণ রয়েছে।
এমনকি কথিত ‘সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনার কিলিং’- এর শিকার হওয়ারও ঘটনা রয়েছে অনেক।
কিন্তু এরপরেও কিছু তরুণ ভারতীয় সমাজ, পরিবার, ধর্ম বা বর্ণের বাধা ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে।
রাভীন্দ্র পারমার তাদেরই একজন। তিনি জানতেন, উচ্চ বর্ণের একটি মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার ফল বিপজ্জনক হতে পারে।
তিনি দলিত সম্প্রদায়ের আর যাকে ভালোবাসেন সেই শিলপাবা উপেন্দ্রসিং ভালা রাজপুত পরিবারের মেয়ে।
“আমরা এমনকি তাদের (রাজপুত) এলাকায় হাঁটার অনুমতিও পেতাম না, অথচ আমি তাদের পরিবারে বিয়ে করতে গিয়ে কোনো কিছুই মানিনি,” বলছিলেন রাভীন্দ্র।
রাভীন্দ্র ও শিলপাবার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা গুজরাটের দুটি আলাদা গ্রামে যার একটি সাথে আরেকটির দূরত্ব প্রায় একশ কিলোমিটার।
ফেসবুকে তাদের পরিচয় এবং সেখান থেকেই প্রণয়।
“আমি আসলে গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো ঘর আর কলেজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। রাভীন্দ্রই আমাকে বুঝিয়েছে যে এর বাইরেও জীবন আছে,” বলছিলেন শিলপাভা।
কিন্তু ভারতের জাতপাত ভেদাভেদ সমাজের খুবই গভীরে প্রোথিত।
উচ্চ গোত্রীয় মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে হত্যার ঘটনাও সেখানে ঘটে।
তাই ভিন্ন জাতের মধ্যে বিয়ে খুব একটা দেখা যায়না। এক হিসেবে এটি দেশটিতে বিয়ের ৫ শতাংশেরও কম।
রাভীন্দ্রকে বিয়ে করতে তাই শিলপাবাকেও বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো কিন্তু হুমকি লেগেই ছিলো।
বাসা ও শহর বদলাতে হয়েছে বারবার।
প্রকৌশলী রাভীন্দ্রকে চাকরি পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছিলো।
এখন তারা দুজনই আইন নিয়ে পড়ছেন।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেবে, ২০১৬ সালেই অন্তত ৭৭টি হত্যাকাণ্ড রিপোর্ট হয়েছে যেগুলোকে ‘অনার কিলিং’ বলা হচ্ছে।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অমিত থোরাট বলছিলেন, “শিক্ষার হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কুসংস্কার এখন অবিশ্বাস্য দুঃখজনক পর্যায়ে আছে।”
নিরাপত্তাহীনতা বোধ
বিবি আয়েশা ও আদিত্য ভার্মা একে অন্যের প্রেমে পড়েছিলেন ১৭ বছর বয়সে। পরিচয় হয়েছিলো ফেসবুকেই।
একজন মুসলিম আরেকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের।
এটা তাদের না ভাবালেও তাদের পরিবার তীব্র আপত্তি জানায় এ সম্পর্কে।
দিল্লীতে বড় হওয়া আদিত্য স্কুল শেষ করে ব্যাঙ্গালুরুতে একটা কলেজে ভর্তি হয়েছেন কারণ সেখানে বাস করতেন আয়েশা।
কিন্তু তাতে পরিবারের মন গলানো যায়নি।
“পাঁচ মাস আমরা একসাথে ছিলাম। মনে হতো যে কোনো মুহূর্তে খুন হতে পারি। কারণ আমি মুসলিম আর সে হিন্দু,” বলছিলেন আয়েশা।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৩ বছর বয়সী অংকিত সাক্সেনা দিল্লীতে খুন হয়েছিলেন প্রকাশ্য দিবালোকে।
তার অপরাধ ছিলো – তিনি একজন মুসলিমের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
আয়েশা বলছিলেন, এরপর তারা বাইরে যেতেন কমই। বাইরে বের হলেও চারদিকে তাকিয়ে সতর্ক থাকতেন।
“মুখে দাঁড়ি আছে এমন কাউকে দেখলেই মনে হতো আমার পরিবারের কেউ আমাকে খুন করতে আসছে।”
বাড়ছে সচেতনতাও
আয়েশার বাবা-মা আদিত্যকে পছন্দ করেছে কিন্তু সে মুসলিম না হওয়া পর্যন্ত তাকে তাদের পরিবারে গ্রহণ করতে রাজী নয়।
আবার আদিত্যর পরিবারও চাইছে আয়েশা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করুক।
যদিও তারা দুজনই নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে চায়।
ভারতে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী ভিন্ন ধর্মের এমন বিয়ের আইনগত বৈধতা নেই।
২০০০ সালে আদিত্য জানতে পারে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট সম্পর্কে।
তারা যখন বিয়ে করলো তারপর গুজরাটের ঘটনার পর তারা দেখলো কিভাবে তাদের টার্গেট করা হয়।
পরে তারা ধানাক নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যারা মূলত সচেতনতা তৈরির কাজ করে, বিশেষত স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নিয়ে।