বাবুভাই সেনমা এবার ভোট দেবেন না। ‘টোটালি বয়কট’; এই দু’টি শব্দ বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন। আরো জানান, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের জেলাতেই যদি আমাদের এমন দশা হয়, তা হলে বুঝতেই পারছেন …।
মেহসানা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে নন্দালি। একেবারেই গ্রাম বলা চলে। পাটেল, ঠাকুর, প্রজাপতি, রাজপুত; সবাই মিলে-মিশে বসবাস। তার সঙ্গে সাত দলিত পরিবারও ছিল।
ছিল বলার কারণ, সেই সাতের মধ্যে দুই পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর বাবু ভাইদের মতো যে পাঁচ পরিবার রয়েছে, তারা কোনো রকমে উপেক্ষা-অবহেলা নিয়ে গ্রামে দিন কাটাচ্ছে। কারণ, পুরো গ্রাম তাদের ‘বয়কট’ করেছে।
সেই গ্রামে দোকান রয়েছে। অথচ একটা দেশলাই বা সামান্য লবণ কিনতে বাবু ভাইদের যেতে হয় চার কিলোমিটার দূরের খেরালুতে।
গ্রামে কূপে পানি নেই। আছে ডিপ টিউবওয়েল। সেখান থেকে পানি নেওয়া একেবারেই বারণ তাদের। পাশের গ্রাম থেকে আনতে হয়।
গ্রামে সব রাজনৈতিক দলেরই কয়েকজন করে নেতা আছেন। তারা কেউই বাবু ভাইদের কাছে ভোট চাইতে আসেননি। না, কোনো দলই নয়।
গ্রামে সেলুন আছে। কিন্তু বাবুভাইদের চুল-দাড়ি কাটতে যেতে হয় সেই খেরালুতেই। এ গ্রামে তারা ক্ষৌরকার্য থেকেও বঞ্চিত।
২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে এভাবেই দিন কাটছে নন্দালির সাত দলিত পরিবারের। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে দুই পরিবার অন্য গ্রামে চলে গেছে। কিন্তু বাবু ভাইরা এখনো থেকে গেছেন, দাঁতে দাঁত কামড়ে। এখনো কোনো বদল হয়নি। নন্দালির অন্য বাসিন্দারা এ বিষয়ে একটি কথাও বলতে চান না। রাস্তায় যে দুয়েক জন ছিলেন, তারা প্রশ্ন শুনে নীরবে এগিয়ে গেছেন। বাবু ভাইয়ের এক প্রতিবেশী বলেন, এখন বিশ্রামের সময়। কথা বলা যাবে না।
কেন এই বয়কট? ৫০ বছর বয়সী বাবু ভাই বলেন, ওই এপ্রিলে মেহসানা জেলা উদ্যোগ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন পুত্রবধূর জন্য একটা সেলাই মেশিনের আবেদনপত্র নিয়ে। সরকারি প্রকল্পেই ওই মেশিন পাওয়া যায় বলে শুনেছিলেন। তার কথায়, যে সরকারি কর্মীর কাছে ওই আবেদনপত্র জমা দিতে গেলাম, তিনি নন্দালির বাসিন্দা। কিন্তু ওই কর্মী আমার আবেদনপত্র না নিয়ে জানিয়ে দিলেন, কপিলা সেনমা মানে আমার পুত্রবধূ সেলাই মেশিন পাবেন না। কেন? জিজ্ঞেস করায় উনি চটে যান। তার পর দুয়েক কথায় বচসা বেধে গেল। আমার গালে একটা চড় কষিয়ে দিলেন ওই সরকারি কর্মকর্তা। আমি দলিত তো, আমাকে মারাই যায়, তাই না! এর পর জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে ওই কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করি।
বাবু ভাই আরো জানান, ওই সরকারি কর্মী এর পর গ্রামে ফিরে সমস্ত গ্রামবাসীকে একত্রিত করে সাত দলিত পরিবারকে বয়কটের দাবি জানান। সেই দাবি গ্রামবাসীরা মেনেও নেয়। তার পর থেকে বাবু ভাইয়েরা নিজের গ্রামেই একা। সরকার সেই অর্থে পদক্ষেপ নেয়নি বলেই অভিযোগ।
তাই বাবু ভাইয়ের সিদ্ধান্ত, এবার ভোট দেব না। টোটালি বয়কট। কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতা-কর্মী, ভোটকর্মী, কেউই আসেননি। তাদের যদি প্রয়োজন না থাকে, আমাদেরও নেই।
এর পর বাবু ভাই মোক্ষম খোঁচাটা দিলেন, মোদিজি প্রধানমন্ত্রী। তার জন্মভূমিতেই যদি দলিতদের এই হাল হয়, তা হলে আর কী-ইবা বলার থাকে।
এই মেহসানার ভডনগরেই জন্ম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। শুধু কি তাই, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ এই মেহসানাতেই পড়াশোনা করেছেন। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দীবেন পাটেল, গুজরাটের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী নিতিনভাই পাটেল; সবার জন্ম এই মেহসানায়।
১৯৮৪ সালে লোকসভায় বিজেপির খাতা খুলেছিল এই মেহসানার হাত ধরেই। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ডেইরি ‘দুধসাগর’ এই জেলাতে। ওএনজিসি-র সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই মেহসানায়। বাবুভাইয়ের ভাই অম্রুতভাই সেনমার কথায়, মেহসানা আসলে ভীষণই পাওয়ারফুল। তা সে রাজনীতি হোক বা অর্থনীতি। সেই পাওয়ারের তলায় আমরা চাপা পড়ে গেছি।
দলিতদের এমন অবস্থা কেন, সে ব্যাপারে বিজেপি নেতা কিসান সিন সোলাঙ্কি বলেন, আসলে ঘটনা তেমনটা নয়। দুয়েকটা জায়গায় সামান্য সমস্যা হয়ত আছে। তবে ওসব মিটে যাবে। চিন্তা করবেন না।
তিনি আরো বলেন, দলিতদের অবস্থা যদি এ রাজ্যে খারাপ হবে, তাহলে কি জিগনেস মেবানী নিশ্চিন্তে বিহারের বেগুসরাইতে কানহাইয়াকুমারকে জেতানোর জন্য পড়ে থাকতেন! এতেই তো বোঝা যায়, গুজরাটে দলিতরা ভালো আছে।
কংগ্রেস এ জে পাটেলকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সারদা বেনও দৌড়াচ্ছেন মোদি-অমিতের ছবি নিয়ে। ভোট চাইছেন। কিন্তু বাবু ভাইদের কাছে যাওয়ার কেউ নেই। বাবু ভাইয়েরা ‘টোটালি বয়কট’…।