পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গরিব অ্যান্ড গরিব গত ফেব্রুয়ারিতে যখন জার্মানিতে তাদের চালান পাঠাল, তখনো সব ঠিকঠাক ছিল। গোল বাধল তখনই, যখন জার্মান ক্রেতা অভিযোগ জানাল যে স্যুায়েটারের কয়েকটি কার্টনে তারা পেয়েছে শুধু ঝুটা কাপড়!
ছোট কোনো কোম্পানির হলে ওই ঘটনাতেই তাদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হতো। তবে ১৮ বছর ধরে পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৪ হাজার কর্মীর প্রতিষ্ঠান গরিব অ্যান্ড গরিব শেষ পর্যন্ত ২০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
গরিব অ্যান্ড গরিবের মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই এভাবে ‘চুরির’ শিকার হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। আর এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুলি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ‘ভাবমূর্তি’ সংকটে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির পথে কার্টনের ভেতর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক। নতুন মোড়কে তা আবার বিক্রি হচ্ছে অন্য কোথাও। আর একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ ডলারের এই ‘কারবার’ চালিয়ে আসছে।
গরিব অ্যান্ড গরিবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল হক ভূঁইয়া জানান, গত ফেব্রুয়ারির ঘটনায় তাদের চালান থেকে প্রায় ৪ হাজার ডলারের পণ্য চুরি যায়। কিন্তু এর জন্য ক্রেতাকে তাদের পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ডলার।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে কেনার সময় পোশাকের জন্য কম দাম দিলেও কোথাও ঝামেলা হলে তার জন্য দাম ধরে তাদের দেশের বিক্রয়মূল্য অনুযায়ী।
“এই অর্থ পরিশোধ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। আবার না করেও উপায় থাকে না। কোনো কোনো কোম্পানি এ রকম অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে দেউলিয়াও হয়ে গেছে”, বলেন নজরুল।
মাত্র ১৫০টি মেশিন নিয়ে যাত্রা শুরু করা গরিব অ্যান্ড গরিবের ব্যবসার পরিধি এখন বেড়েছে অন্তত দশ গুণ। কিন্তু কম্পানির গেইট থেকে বন্দর পর্যন্ত পথে কার্টন থেকে পণ্য চুরি যাওয়ার ঘটনায় নজরুল হককেও উদ্বেগে ভুগতে হচ্ছে।
তিনি জানান, সাধারণত রপ্তানির পোশাক বোঝাই কার্টনগুলো তারা কভার্ড ভ্যানে করে চট্টগ্রামে পাঠান। সেখান থেকে সেগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যের জাহাজে তোলা হয়। আর এর মধ্যেই কোথাও চুরির ঘটনা ঘটে।
“এরপর ক্রেতারা খালি বা ঝুটাবোঝাই কার্টনের ছবি তুলে আমাদের পাঠায়। আমাদের গুণতে হয় উৎপাদন খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা”, বলেন নজরুল।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক হয়ে উঠেছে যে নামকরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা এইচ অ্যান্ড এম এ ধরনের চুরির ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
সুইডিশ এ কোম্পানির হিসেবে, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে তাদের কেনা প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার পোশাক চুরি হয়েছে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই।
এই রপ্তানি পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সবচেয়ে ‘সমস্যাসঙ্কুল স্থান’ হিসাবে চিহ্নিত করে যতো দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নেওয়ারও সুপারিশ করেছে এইচ অ্যান্ড এম।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, “এ ধরনের চুরির ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। গত জানুয়ারি থেকে ১০ থেকে ১২টি চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা জেনেছি। কোন সংঘবদ্ধ চক্র এটা ঘটাচ্ছে তা চিহ্নিত করে তাদের নির্মূল করতে হবে।”
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “রপ্তানির ক্ষেত্রে চুরি হওয়ায় আমাদের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে।”
বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতিও বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুরি হয় চট্টগ্রামে পণ্য পাঠানোর সময় কুমিল্লা এলাকার কোথাও। ট্রাক বা কভার্ড ভ্যান থেকে কয়েকটা কার্টন বা ভেতরের কাপড় ‘হাওয়া’ হয়ে যায়।
এর পেছনে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত বলেই তার বিশ্বাস।
রপ্তানির চালান থেকে পণ্য চুরির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক হুমায়ুন কবীর লেন, এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন কুমিল্লা অঞ্চলের সুপারিনটেন্ডেন্ট।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের সুপারিনটেন্ডেন্ট আনোয়ার জামান বলেন, “গত কয়েক মাসে এ ধরনের কোনো মামলা আমরা পাইনি। ট্রাক মালিকদের বলা হয়েছে, যাতে তারা চালকদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেন। তাছাড়া আমরাও বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়েছি।”