২৮ মার্চ। বেলা দেড়টা। মকবুল আহমেদের মোবাইল ফোন বাজছিল। মোবাইলের পর্দায় ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুকের নামটা ভেসে উঠছিল।
মকবুল আহমেদ ফোন ধরলেন। অপর প্রান্ত থেকে ছেলে ফারুক বললেন, ‘আব্বা, আমাদের ভবনে আগুন লেগেছে। আমরা এখনো ভালো আছি। ধোঁয়া আসছে। আব্বা আমাকে বাঁচান।’
ছেলের মুখে এই কথা শুনে বুক কেপে ওঠে মকবুলের। ছেলে ফারুককে বললেন, ‘বাবা, ওপরের দিকে উঠে যাও। ছাদে চলে যাও।’
এর আগে আগুন লাগার পর ফারুক প্রথমে কথা বলেন মা জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে।
মাকে ফারুক বলেন, ‘মা, মাগো, আমার অফিসে আগুন লেগেছে। মা, দোয়া করেন।’
মকবুল তখন পল্টনে নিজের অফিসে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলেন বড় ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে। জানালেন আবদুল্লাহ আল ফারুকের অবস্থা। বনানীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মকবুল। যানজটে কিছুক্ষণ আটকা পড়েন। দুইটার পর পৌঁছে যান তিনি। তখন সেখানে চলে এসেছেন ফারুকের বড় ভাই মামুন।
বড় ভাই মামুনের সঙ্গে ফারুক কয়েকবার কথা বলেন। জানান নিজের অবস্থা। বাবা মকবুল দেখছেন, এফ আর টাওয়ার জ্বলছে। ছেলে ফারুক সেই ভবনে। বেলা ৩টার পর ফারুক আর ফোন ধরছিলেন না।
তখন বড় ভাই মামুন ফারুকের মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠান। বার্তায় বলেন, ভাই ফারুক, ছাদের ওপরে উঠে যাও।
কিছুক্ষণ পর ফারুকও ফিরতি বার্তা পাঠান। সময় তখন ৩টা ২৯ মিনিট।
ফারুক মামুনকে লেখেন, ‘ভাইয়া, নো স্কোপ।’
বাবা মকবুল আহমেদ তখনো এফআর টাওয়ারের সামনে। মকবুল বললেন, ‘ফারুক লিখল, নো স্কোপ। ছেলের কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর বাবার মনের অবস্থা কেমন হয়, তা কি বলে বোঝানো যাবে? তখনো ধোয়ার কুণ্ডলী, আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে।’
সাড়ে তিনটার দিকেও এফ আর টাওয়ারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অথচ ফারুকের মোবাইল তখন বন্ধ।
বাবা মকবুল কল দিচ্ছেন।
শোনা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সংযোগ হচ্ছে না।
মকবুল বললেন, ‘কতবার যে ফারুকের মোবাইল কল দিয়েছি।’
একটু আগেও বড় ভাই মামুন, বাবা মকবুল মোবাইল ফোনেও ফারুককে বারবার বলেছে, ‘ফারুক, উপরে উঠে যাও। ছাদে যাও।’
মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ার পর বাবা মকবুলের অপেক্ষার পালা শুরু। নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন ফারুকের কোনো সংবাদ পাওয়া যায় কি না।
সাড়ে তিনটায় ফারুকের মোবাইল ফোন বন্ধ। এর চার ঘণ্টা পর ভবনে আটকে পড়া ফারুকের দেখা মেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
মকবুল বললেন, ‘যে ফারুক আমাকে বলেছিল, বাবা আমাকে বাঁচান। সেই ফারুক আমার চোখের সামনে শুয়ে আছে লাশ হয়ে। আমি, আমরা কেউ ফারুককে বাঁচাতে পারলাম না।’
ফারুকের দুই হাত, হাতের আঙুল পুড়ে যায়। মুখমণ্ডল অক্ষত ছিল। ফারুকের কাছে অফিসের আইডি কার্ড। বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট কার্ড। যারা ফারুককে উদ্ধার করেন, সহজেই ফারুকের পরিচয় পেয়ে যান।
মকবুল জানালেন, আগুন লাগা ভবনের কাছে পুলিশের কন্ট্রোল রুম। সেখান থেকে প্রথমে জানতে পারেন ফারুকের মৃত্যুসংবাদ।
বাবা মকবুলের সঙ্গে ফারুক সেদিন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হন। মকবুল যান নিজের অফিসে। ফারুক চলে যান বনানীর এফ আর টাওয়ারে। ডেমরার সারুলিয়ায় স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে থাকতেন ফারুক।
ডেমরায় ফারুকের কবর দেওয়া হয়েছে। ফারুকের স্ত্রী, দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বাবা মকবুল। ইডেন থেকে স্নাতকোত্তর করা ফারুকের স্ত্রী চাকরি করেননি। তিনি গৃহিণী।
মকবুল বললেন, ‘আমার বয়স এখন ৭৩ বছর। আর কয়দিনই বা বাঁচব। ফারুকের স্ত্রী, দুই সন্তান কোথায় যাবে, কীভাবে বড় হবে।’
ফারুকের মৃত্যুর জন্য এফ আর টাওয়ারের মালিককে দায়ী করলেন মকবুল। তিনি বললেন, ’১৮ তলা অনুমোদন নিয়ে ২২ তলা হলো। আগে এই ভবনে আগুন লাগল। এত দিন রাজউক কী করল? এতগুলো মানুষ মারা গেল।’
মকবুল বললেন, ‘ছেলের মৃত্যুর জন্য রাজউকের বিচার চাই। ভবনমালিকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই। মৃত্যুর জন্য জড়িতদের শাস্তি চাই।’
মকবুল বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনে চাকরি করতেন। বছর কয়েক অবসর নিয়ে এখন চাকরি করেন আজাদ প্রডাক্টসে। ফারুকেরা তিন ভাই। বোন ছিল না। ফারুকের বড় ভাই মামুন, ছোট ভাই মাসুদ।
আবদুল্লাহ আল ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ইইউআর সার্ভিসেস বিডি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। পদ ছিল সহকারী ব্যবস্থাপক। ফারুকের স্ত্রীর নাম সানজিদা আক্তার। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছেলের নাম আয়মান। মেয়ের নাম তেহরিন। বয়স ১ বছর ৯ মাস।