ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘ইফ লাইফ গিভস লেমন, মেক লেমনেড অ্যান্ড ড্রিংক ইট’। বলিউডের চিরসবুজ অভিনেত্রী রেখার জন্য কথাটি আপাদমস্তক সত্যি। জন্মের পর থেকে ৬৪টি বসন্ত অবধি জীবনের ছুড়ে দেওয়া তিরগুলোকে সাহসের সঙ্গে প্রতিহত করে এগিয়ে চলেছেন নিজ সক্ষমতায়। চেন্নাই থেকে জীবনের সন্ধানে তখনকার বোম্বেতে ছুটে আসা এক কৃশকায় কিশোরী পুরুষশাসিত বলিউডে রাজত্ব করেছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে।
সাংবাদিক ইয়াসির উসমানের ‘রেখা, দি আনটোল্ড স্টোরি’ বইয়ে দেখা মিলেছে ভিন্ন এক রেখার। যে রেখা প্রকৃতই একজন যোদ্ধা, একজন ভানুরেখা।
oজন্মই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল রেখার। শক্তিমান তামিল অভিনেতা জেমিনি গনেশন ও তেলেগু অভিনেত্রী পুষ্পাভ্যালীর ঘরে রেখার জন্ম ১৯৫৪ সালে। তবে রেখার মায়ের ছিল না বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি। সে কারণেই রেখার জন্মের পরে বাবার স্বীকৃতি মেলেনি। পিতার স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিয়ে নিয়তি মুচকি হাসলেও রেখা সেই হাসিকেই ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন জন্মেও মাত্র ৪০ বছর পর। নিজের যোগ্যতায় কণ্টকাকীর্ণ বলিউডের শক্ত সিঁড়িগুলো চড়ে রেখা তখন সাফল্যের শীর্ষে। বলিউডের অস্কার ফিল্মফেয়ারের পুরস্কারের আসর বসে মাদ্রাজে ১৯৯৪ সালে। এই অনুষ্ঠানে জেমিনি গনেশনকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। বাবার হাতে আজীবন সম্মাননার পুরস্কার তুলে দেন তাঁর স্বীকৃতি না পাওয়া কন্যা রেখা। জন্মের পর থেকে যে সন্তানকে স্বীকৃতি দেননি, ফিল্মফেয়ারের ভরা আসরে হাজারো লোকের মাঝে জেমিনি সেই কন্যা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি খুশি এই পুরস্কারটি বোম্বে থেকে আসা আমার প্রিয় সন্তানের কাছ থেকে নিতে পেরেছি।’ হাজার লোকের ভরা আসরে বাবার দেওয়া এই স্বীকৃতি জয় করে নিয়তিকে জন্মক্ষণের সেই মুচকি হাসিটা ফিরিয়ে দেন বিজয়িনী রেখা।
জীবনের ছোটবড় চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমরা যারা হতাশার সাগরে সাঁতরে বেড়াই, তাদের জন্য রেখার এই স্বীকৃতি আদায় এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোরে, তখনো নিয়তির সুপ্রসন্নতার দেখা পাননি রেখা। সংসার আর মায়ের ঋণ মেটানোর প্রয়োজনে ১৪ বছর বয়সেই রঙিন চলচ্চিত্র জগতের অন্ধকার সিঁড়ি বাইতে শুরু করেন তিনি। নানান চড়াই–উতরাই পেরিয়ে রেখা হয়ে ওঠেন তাঁর ছয় সদস্যের পরিবারের আলো। রেখা তাঁর পরিবারকে একাই এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এই নারী নিজেই বলেছেন, ‘বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম আমার ভাইবোনদের মা, এমনকি আমার মায়েরও মা।’
রঙিন পর্দায় লাস্যময়ী রেখার আবেদন, নাচ, অভিনয় আরও অনেক কিছুতে তিনি জুড়ে আছেন বড় জায়গা। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কয়েক দশক ধরে হয়েছিল একটি দেশের জাতীয় ইস্যু। তবে সবকিছুর অন্তরালে পুষ্পাভ্যালীর পরিবারকে কঠোর পরিশ্রম করে আগলে রাখা যে রেখা, সেই নারী অন্য আর সবার জন্য উদাহরণ। বুড়ো বয়সে ছেলে দায়িত্ব নেবে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের জন্যও উদাহরণ তিনি। এক নারীর একটি পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠার এই গল্প সমাজের সেই সবার জন্যই অনুপ্রেরণা, যাঁরা মেয়েদের এখনো পিছিয়ে রাখেন।
সফল রেখার খ্যাতি অনেক চোখে স্বপ্ন জাগায়। অনেক জীবনকে অনুপ্রাণিত করে। তবে সফলতার যে চূড়ায় রেখাকে দেখা যায়, সেই পথটা ততটাই কণ্টকাকীর্ণ ছিল। ১৪ বছরের কিশোরীর ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ানো ছিল এক বিব্রতকর ঘটনা। প্রথম দিনের শুটিংয়ে রেখাকে কোনো কিছু না জানিয়ে পরিচালক আয়োজন করেন একটি ‘চুমু দৃশ্য’।
ক্যামেরার সামনে অতর্কিত সহ-অভিনেতার সে আচরণ, পুরো শুটিং সেটের সব কর্মীর উল্লাসে চুপসে যায় কৃশকায় কিশোরী। তবে ক্যামেরার সামনে পুরুষশাসিত বলিউডের সেই আচমকা আচরণে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাননি তিনি। সব প্রশ্নের সব জবাব মোকাবিলা করে এগিয়ে গেছেন সমান্তরালে। রেখার অভিনয় কখনো প্রশংসা কুড়িয়েছে, কখনো সমালোচনা। নিজেকে বারবার ভেঙে গড়েছেন তিনি। তাঁর পেশার প্রয়োজনে হয়ে উঠেছেন ভিন্ন একজন। ক্যামেরার পেছনের জীবনের চড়াই–উতরাই চলেছে সমান্তরালে। বারবার সম্পর্কে জড়িয়ে প্রতারিত হয়েছেন, ফিরে এসেছেন তবে সংসার বাঁধা হয়নি। পরে যখন দিল্লির ব্যবসায়ী মুকেশের সঙ্গে ঘর বাঁধেন, সেখানেও ধাক্কা আসে কিছুদিন পরই। এরপর মুকেশের আত্মহত্যায় ‘জাতীয় ডাইনি’তে পরিণত হন রেখা। বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভের সঙ্গে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ সম্পর্ক নিয়েও এখন পর্যন্ত জল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন তিনি। তবে জীবনের এই যে সব উত্থান-পতন, রেখা তা সামলেই হয়ে উঠেছেন।
তাই কেবল অভিনয় পেশা বা রুপালি জগতে নয়, যেকোনো পেশায় বা যেকোনো জীবনে সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যারা ভাবি, ‘আমার সঙ্গেই এমন কেন হলো?’ তাদের জন্যও রেখার গল্প শিক্ষণীয় হতে পারে। জীবন তার তালেই তার গন্তব্যের দিকে এগোবে। সেখান উত্থান থাকবে পতন থাকবে, অবহেলা থাকবে গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, অন্ধকার রাত থাকবে আলোকিত দিন থাকবে। তবে জীবন যা নিয়েই হাজির হোক, আমি কীভাবে তা নিচ্ছি, সেটাই এগিয়ে যাওয়া।
রেখার নামকরণ করা হয়েছিল ভানুরেখা। যার অর্থ সূর্যের আলো। সফল অভিনেত্রী, তারকাশিল্পী, আবেদনময়ী নৃত্যশিল্পী এমন নানা পরিচয়ে বলিউড ইতিহাসের পাতায় রেখা জলজলে হয়ে থাকবেন নিঃসন্দেহে। তবে জীবনের দুর্যোগ মোকাবিলা করে কঠিনকে গলিয়ে অনন্য হয়ে ওঠা যে ভানুরেখা, তিনি যুগে যুগে সাহস জোগাবেন অনেক কিশোরী, তরুণী, নারীকে।