তাঁর পুরো নামটা লেখা যাচ্ছে না। দিনের মধ্যভাগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর সে ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তখনো। বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় এক দেশে আশ্রয় নিয়েও জীবন হারাতে বসেছিলেন একটু আগেই। এমন ঘটনার পর কাউকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ব্যক্তির।
দ্য প্রেসের সাংবাদিকদের তাই শুধু মিরওয়াইজের নামটা জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য যিনি আজ জীবনকে নতুন করে ফিরে পেয়েছেন।
ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে আজ হামলা করেছে এক সন্ত্রাসী। পূর্বপরিকল্পিত সে হামলার মুহূর্তে আরও প্রায় তিন শ মুসল্লির সঙ্গে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন মিরওয়াইজও। আর্মি কমব্যাট পরে হাজির হওয়া অস্ত্রধারীর প্রথম হামলার মুখে পড়েছিলেন এই আফগান, ‘সে কক্ষে ঢুকে আমাদের অংশে প্রথমে গুলি করা শুরু করে। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়েছিলাম, এমন অবস্থায় একটা বুলেট আমার মাথায় আঁচড় কেটে বেরিয়ে যায়। আর কয়েক সেন্টিমিটার হলেই মরে যেতাম। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ও আরও অনেকেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল সেখানে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছেড়ে ছবির মতো সুন্দর নিউজিল্যান্ডে নিরাপদে থাকতে এসেছিলেন মিরওয়াইজ। সেখানে এসে মসজিদে নামাজের সময় গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে বড় এক ধাক্কা খেলেন তিনি। অস্ত্রধারীর তাণ্ডব তখনো চলছে, ‘সে এবার কক্ষের অন্যদিকে গুলি করা শুরু করল। সুযোগ বুঝে কয়েকজনকে ডিঙিয়ে আমি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাই।’ মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেয়াল টপকে পাশের এক বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন মিরওয়াইজ। কিন্তু ভীতসন্ত্রস্ত তরুণ দম্পতি কোনো ধরনের সাহায্য করতে ব্যর্থ হন, ‘আমি তখনো গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। একটা সময় গুলি শেষ হয়ে এল, সে আবার রিলোড করল এবং গুলি করা শুরু করল। শত শত গুলি করেছে সে। মানুষ চিৎকার করছিল, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল।’
বুলেটের আঁচড় নিয়েই ডিনস অ্যাভিনিউতে পৌঁছান মিরওয়াইজ। সেখানেও রাস্তা রক্তে ভরে উঠেছিল। সেখানে আরেক আহত ব্যক্তির শরীরে ব্যান্ডেজ লাগাতে সহযোগিতা করেছেন মিরওয়াইজ, ‘এত মানুষ মারা গেল! আমি শোকাভিভূত। এর চেয়ে বাজে দিন আর কখনো আসবে না। সন্ত্রাসবাদের সামনে কেউ নিরাপদ নয়।’
এদিকে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, নামাজের খুতবা শুরু হওয়ার পরই হামলা শুরু হয়েছিল। ঘটনার শুরুতে আদ্রিয়ান রাইট বুঝতেও পারেননি কী ঘটছে, ‘আমি প্রথমে একটা শব্দ শুনলাম, অনেকটা বাল্ব (বাতি) ফাটলে যেমন হয়। অনেকটা “প্যাপ” “প্যাপ”, এমন এক শব্দ।’ কিন্তু শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়েই ভুল ভাঙে তাঁর। মসজিদের ভেতরে নাকি বৃষ্টির মতো বুলেট ছিটকে বেরোচ্ছিল। এরপরই জানালার দিকে ছুটে গেছেন রাইট। জানালা টপকে গাড়ির পার্কের দিকে বেরিয়ে এসেছেন।
এর মাঝেই ভয়ংকর সে দৃশ্য স্মৃতিতে গেঁথে গেছে তাঁর, ‘লোকটা এল আর একজন একজন করে গুলি করা শুরু করল। বসে আছে এমন লোকদের গুলি করল… সে এল আর তাদের গুলি করল। সে অস্ত্রে গুলি ভরার জন্য বের হলো এবং আবার ভেতরে ঢুকল। এবার বেছে বেছে শব্দ করছে বা নড়ছে এমন লোকদের খুঁজে বের করে খুন করা শুরু করল।’
নিহতদের মধ্যে অনেকেই রাইটের পরিচিত। অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন, নামাজ পড়েছেন। এক বন্ধু ও তাঁর বাবাও আছেন নিহতদের মধ্যে। গাড়ি পার্ক করার জায়গাতেও সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছিল। সেখানে অনেক বয়স্ক লোক ছিলেন যাদের দেয়াল টপকানোর ক্ষমতা ছিল না। সে মুহূর্তের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে রাইটের কথায়, ‘ওরা একদম অসহায় হয়ে অপেক্ষা করছিল আর ভাবছিল সন্ত্রাসী কি আবার ফিরে আসবে, সে কি তাদের খুন করবে। যাঁরা আজ হারিয়ে গেলেন তাদের জন্য এখন শুধু প্রার্থনা করার আছে। আর এই যে জীবিত আছি, পরিবারের কাছে যেতে পারছি এবং কী ঘটল সেটা বোঝার চেষ্টা করছি, এর জন্যই ধন্য মনে করছি নিজেকে!’