“রাত ১০টা ৮ মিনিটে তার সাথে আমার মোবাইলে কথা হইছে। বলেছিল, ‘আসো আমি মসজিদের কাছে থাকবো।’ দোকান বন্ধ করি ফিরছিলাম। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ, দেখি চারদিকে আগুন। তখন ১০টা ৩০ মিনিট। তার মোবাইল ফোনে দুইটা কলও ঢুকলো। এরপর বন্ধ। আর কোথাও খুঁজে পাইলাম না। মনেরে বোঝাইতে পারি না। লাশটা আছে জানলে একটু সান্ত্বনা পাইতাম…।” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন রাজধানীর চকবাজারের বিভিন্ন ধরনের ব্যাগের দোকানদার জহিরুল হক সুমন। তাঁর স্ত্রী বিবি হালিমা শিল্পী গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বামীর ফেরার সময় হাজি বালুগেটের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। এরপর তাঁর আর খোঁজ মেলেনি। আহত ও নিহতদের ভিড়ে হন্যে হয়ে স্ত্রীকে খুঁজেছেন সুমন। এখন তাঁর আশা, ডিএনএ পরীক্ষায় যদি মেলে হদিস। পাঁচ বছরের শিশু বিবি মরিয়ম সানিন শুধু মাকে দেখতে চাইছে। মাত্র পাঁচ মাস ২০ দিনের আরেকটি শিশুসন্তান আছে সুমন ও শিল্পীর।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সুমন ও সানিনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রিয়জনের দেহাবশেষটুকু পাওয়ার আশায় নমুনা দিয়েছে মোট ৪৯ জন।
গতকাল বুধবার পর্যন্ত ঢাকা জেলা প্রশাসন ও সিআইডির কাছে আসা এসব স্বজনের দাবি অনুযায়ী, এখনো নিখোঁজ ২৩ জন। তাদের নাম-পরিচয়ের তালিকা কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। এর মধ্যে ১৯টি লাশ মর্গে রয়েছে, যেগুলো শনাক্ত হয়নি। এ হিসাবে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩।
প্রশাসনের হিসাব মতে, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৬৯। প্রথম ধাপে ৪৬ এবং পরে আরো চারজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুড়ে খণ্ডিত হওয়ার কারণে লাশের হিসাব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ডিএনএ পরীক্ষায় এটি শনাক্ত হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, ‘১৯টি মরদেহের একাধিক দাবিদার হিসেবে অনেকেরই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মানবিক বিবেচনায় এবং সঠিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য যারাই আসছে, তাদের ডিএনএ নমুনা রাখা হচ্ছে।’
চকবাজারে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন কামরাঙ্গীর চর এলাকার রিকশাচালক মো. শাহাবুদ্দীন (৩৩)। তাঁর পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ নমুনা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি—পরিবারটির পাঁচজন।
স্বজনরা জানায়, ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার মধ্যজয়নগর গ্রামের শাহাবুদ্দীন কামরাঙ্গীর চরে গ্যারেজে থেকে রিকশা চালাতেন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে লোহারপুল এলাকা থেকে যাত্রী নিয়ে চকবাজারে আসেন তিনি। এরপর অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়েন।
চকবাজারে প্লাস্টিকের পণ্যের ব্যবসায়ী ফয়সাল সারোয়ারের (৫৩) শেষ চিহ্নটুকু পায়নি স্বজনরা। তাঁর মেয়ে ফাহিমা তানজীম (১৮) সূচী বলেন, ঘটনার রাতে রহমতগঞ্জের বাসায় যাওয়ার আগে তাঁর বাবা চুড়িহাট্টায় চায়ের দোকানে যান। ওই সময় সারোয়ারের সঙ্গে তাঁর বন্ধু মাহবুবও ছিলেন। দগ্ধ মাহবুব এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
মদিনা গ্রুপের সিনিয়র ক্যাশ এক্সিকিউটিভ নাসরিন জাহান (৩২) ও তাঁর স্বামী কামরাঙ্গীর চরের ইগলু আইসক্রিমের পরিবেশক সালেহ আহমেদ লিপু (৩৫) এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান আফতাহীকে (৭) খুঁজে পাচ্ছে না স্বজনরা। ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি (২৫) ও রেহনুমা তাবাসসুম দোলা (২৫) নামের দুই শিক্ষার্থীও নিখোঁজ আছেন। বৃষ্টি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের এবং দোলা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্রী।
একইভাবে কেরানীগঞ্জের রাইতা আটির বাসিন্দা ও চকবাজারে স্টেশনারির দোকানদার এনামুল হকের লাশ পেতে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন তাঁর বাবা ও বোন। ঘটনাস্থলের কাছের সবজি বিক্রেতা নূরুল হককে খুঁজছে ভাই আয়নাল হকসহ পরিবারের তিনজন; চকবাজারের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাফরের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছে তাঁর দুই ছেলে। চকবাজারের প্লাস্টিকের কারখানার মালিক আহসান উল্লাহর সন্ধান চায় স্ত্রী বিবি কুলসুমসহ স্বজনরা। আগামাসি লেনের বিবিএর ছাত্র তানজিল হাসানের খোঁজ চান তার বাবা মো. হাসান ও মা রুবিনা ইয়াসমিন; নারায়ণগঞ্জের দেলপাড়ার রিকশাচালক নূরুজ্জামান হাওলাদারের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছে স্বজনরা। সোয়ারীঘাটের রিকশাচালক হেলালের জন্য এসেছে দুই ভাই। চকবাজারের পণ্য সরবরাহকারী শাহিন আহমেদের খোঁজে এসেছে স্ত্রী-সন্তানরা। ইব্রাহিমেরও সন্ধান চাইছে স্ত্রী-সন্তানরা। ছেলে রফিক মিয়ার খোঁজে এসেছেন বাবা। নূরুল ইসলামের জন্য এসেছে তাঁর ছেলে। হাজি ইসমাইলের জন্য এসেছে ছেলে। মোস্তফার সন্ধান চান বাবা-মা। রাজুর মা ও দুলাল কর্মকারের ছেলে তাঁদের খোঁজ করছেন।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-ফরেনসিক) রুমানা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চুড়িহাট্টায় নিহত ৬৭টি মরদেহ থেকে ২৫৬টি (রক্ত, টিস্যু, হাড় ও বাক্কাল সোয়াব) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি বিচ্ছিন্ন হাতকে পৃথক আলামত হিসেবে গণ্য করা হলে মোট সংগৃহীত নমুনার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৭। আজ (গতকাল) পর্যন্ত ৪৯ জন স্বজনেরও ডিএনএ নমুনা রাখা হয়েছে।’
ঘরে ফিরলেন দগ্ধ তিনজন : চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ তিনজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন মোজাফফর উদ্দিন (৩২), সালাউদ্দিন (৪৫) ও হেলাল সিকদার (১৮)।