২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হলে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্র জয় নিশ্চিত করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা মামলায় বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমুদ্রসীমায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় ছাত্রলীগ আয়োজিত সম্বর্ধনায় তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে যে মামলা রয়েছে তাতেও জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ওই মামলার রায় হবে ২০১৪ সালে। সে বছরের জানুয়ারির মধ্যে মহাজোট সরকারের ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ হবে। জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সেই নির্বাচনে জনগণ যদি ভোট দিয়ে তার দলকে আবার নির্বাচিত করে তাহলে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ মামলায়ও বাংলাদেশের জয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সংবর্ধনামঞ্চে বক্তব্য দানের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিকাতর হয়ে ৩১ বছর আগে তার দেশে ফেরার পথে তৎকালীন সরকারের বাধা দানের ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আজ থেকে ৩১ বছর আগে এইদিনে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম। ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো আমাকে দেশে ফিরতে দিতে চায়নি।“
দলীয় ও জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল পৌনে ৪টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে তিনি বক্তব্য শুরু করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, “২০০৮ সালে জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিলো বলেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে সমুদ্রসীমা জয় করা।“ তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তারা মানুষ হত্যা করছে।“
হরতালে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি প্রশ্ন করেন, “এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে কিভাবে পুড়িয়ে মারে? আমরা যখন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছি তারা তখন মানুষ পুড়িয়ে মারছে।“
এ ব্যাপারে সরকার কঠোর মনোভাব বা জিরো টলারেন্স নীতিতে এগোবে এই ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের কিভাবে সঠিক পথে আনতে হয় তা আমাদের ভালোই জানা আছে।“
এর আগে বিকাল সোয়া ৪টায় মঞ্চে উপবেশনের পর প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট উপহার ও উত্তরীয় পরিয়ে দেন ঢাকা মহনগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা।
তিনি বিকাল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন।
বিকাল সোয়া ৪টার দিকে বক্তব্য শুরু করেন ছাত্রলীগ সভাপতি এসএম বদিউজ্জামান সোহাগ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, সহ-অধিনায়ক মাহমুদউল্লা রিয়াদ, এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহিম ও জাতীয় ফুটবল দলের জাহিদ হাসান এমিলি।
ছাত্রলীগ সভাপতি এসএম বদিউজ্জামান সোহাগের পর বক্তব্য শুরু করেন এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহিম।
মুসার পরে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপর বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রায় আধা ঘণ্টার বক্তব্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের নৈরাজ্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা এসব সহ্য করছি। এর মানে এই না যে, এটা আমাদের দুর্বলতা। আমি বিরোধীদলকে আহ্বান জানাবো সঠিক পথে ফিরে আসুন। এসব পরিহার করুন।“
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করে নির্বাচন আদায় করেছি। দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের দানব আর দেখতে চায় না।“
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে এ সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। তবে দুপুর ২টা থেকেই সম্বর্ধনাস্থল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র দলীয় নেতাকর্মীদের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে।
বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের ভেতর বাইরে নেতাকর্মীদের ভিড়ে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা।
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সমুদ্র বিজয়ের জন্য এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ১৮ এপ্রিল যুবলীগ এবং ২৮ এপ্রিল নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।
জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানাই
৩১ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ও সমুদ্রজয়ের জন্য ছাত্রলীগের দেয়া সম্বর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “২০০৮ সালে জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিলো বলেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে সমুদ্রসীমা জয় করা। এ জন্য দেশের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানাই।“
“স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সমুদ্রসীমা আইন করে গিয়েছিলেন। এরপর আমরা ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সমুদ্র সীমায় অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও যাই“–উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বিএনপির নেতিবাচক ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, “ কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এমন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নয়। আমরা ২০০৮ এর নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে মামলা করে মিয়ানমারের সঙ্গে বিজয় অর্জন করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির নেত্বাধীন সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপির ৫ বছরে বাংলাদেশের পরিচয় হয়েছিলো জঙ্গিবাদ, লুটপাট, দুর্নীতি, দুঃশাসনের দেশ হিসেবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ছিলো অপশাসন।
বাংলাদেশের মানুষ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক দানব আর দেখতে চায় না। অনেক সংগ্রাম করে আমরা নির্বাচন আদায় করেছি।
বিরোধী দল কী কারণে হরতাল দিচ্ছে?
এসময় বিরোধী দলের ডাকা হরতাল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা যথাসময়ে সকল পরীক্ষা শেষ করার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বারবার হরতাল দিয়ে এইচএসসি পরিক্ষা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বারবার পরীক্ষা পেছালে লেখাপড়া থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বিরোধী দল কী কারণে হরতাল দিচ্ছে? “
“তারা (বিরোধী দল বিএনপি) বাসের মধ্যে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে“ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ একজন মুসলমান আরেক জন মুসলমানকে কিভাবে পুড়িয়ে মারে? ৫ জন মানুষকে তারা পুড়িয়ে মারলো কি কারণে? তারা কি ভুলে গেছে তারা কত মানুষকে হত্যা-নির্যাতন করেছিলো? মানুষ তাদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা ভুলে যায়নি।“
প্রতিশোধ আমরা নেইনি
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশোধ নিতে পারতাম কিন্তু প্রতিশোধ আমরা নেইনি। আমরা ব্যস্ত আছি দেশের উন্নয়নে, মানুষের উন্নয়নে। আমরা যখন মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি তখন তারা পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে। “
গণতন্ত্রের পথে আসুন
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে বলেন, “মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ করুন। আমরা এসব সহ্য করছি তার মানে আপনারা মনে করবেন না এটা আমাদের দুর্বলতা। এটা আমাদের দুর্বলতা না। আমরা জানি কিভাবে আপনাদের সঠিক পথে আনা যায়, সেটা আমাদের ভালোই জানা আছে। কিন্তু আমরা তা করতে চাই না।“
“আমরা চাই বিরোধী দল সঠিক পথে আসুক, সঠিক পথে চলুক। বিরোধী দলকে আমি বলবো এই পথ পরিহার করে গণতন্ত্রের পথে আসুন। “
দেশের মানুষই বাবা-মার মতো স্নেহ দিয়েছে
এসময় শেখ হাসিনা তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার বাবা মা ভাইসহ পরিবারের সকলকে হত্যার পর আমাদের দেশে আসতে দেয়া হয়নি। ১৯৮১ সালে যখন দেশে আসি তখন লাখো মানুষ বিমানবন্দরে গিয়েছিলো। মানুষের চাপে সে সময়কার সরকার বাধা দিতে পারেনি। তাদের কথা আমি চিরদিন মনে রাখবো।“
শেখ হাসিনা বলেন, “৭৫ সালের ৩০ জুলাই আমরা জার্মানি যাই তখন আমার বাবা-মা সবাই ছিলো কিন্তু ৮১ সালে যখন ফিরে আসি তখন তাদের কাউকে পাইনি। এই দেশের মানুষই আমার বাবা-মার মতো স্নেহ দিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে।
এই দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনে আমি রক্ত দিতে প্রস্তুত। রক্ত দিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়বো, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবো। “
ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগের সভাপতিত্বে এ সম্বর্ধনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মণি, এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম প্রমুখ।
সম্বর্ধনায় শেখ হাসিনাকে ক্রেস্ট উপহার ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এসময় দেশাত্ববোধক গান ও গীতি-নৃত্য পরিবিবেশিত হয়। সম্বর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে মানপত্র পাঠ করেন ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে প্রধানমন্ত্রীর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতাসীনদের বাধায় দীর্ঘদিন দেশে আসতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়ে তিনি ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। এ কারণে তারা দুজন সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যান।
উল্লেখ্য, সমুদ্রজয়ের জন্য এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ১৮ এপ্রিল যুবলীগ এবং ২৮ এপ্রিল নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।