বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে বিদেশিরা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আমেরিকানদের তাৎপর্যপূর্ণ যে ১৩টি বিদেশি ভাষা শেখার জন্য বৃত্তি দেয় তার অন্যতম হলো বাংলা। এটি বাংলাদেশের প্রধান ভাষা হওয়ার কারণে এ দেশের সঙ্গে দূতিয়ালি, অন্যান্য পেশা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেও বাংলায় কথা বলা শিখছে বিদেশিরা।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অর্থায়নে পরিচালিত ‘ক্রিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ স্কলারশিপ (সিএলএস)’ কর্মসূচিকে সাজানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে। একুশ শতকের বৈশ্বিক জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে তারা বাংলা, আরবি, হিন্দি, চীনা, রুশ, ফার্সিসহ ১৩টি ভাষাকে চিহ্নিত করেছে।
সিএলএস আমেরিকান শিার্থীদের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় লোকজন বাংলা ভাষায় কথা বলে। এটি সারা বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে সপ্তম।
সিএলএস বলেছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিগুলো ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে এবং এই অঞ্চলের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বাড়ছে। এমন প্রোপটে আন্তর্জাতিক ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, অলাভজনক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বাংলার মতো ভাষার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে।’
বাংলার গুরুত্ব তুলে ধরে সিএলএস আরো বলেছে, বাংলার সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় ইতিহাস আছে। এই ভাষার গর্বের সাহিত্য ঐতিহ্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন। ব্যবসায় শাস্ত্রে অধ্যয়নরতদের মধ্যে যারা উন্নয়নশীল অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা, বিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চান এবং নৃবিজ্ঞানী ও এথনোমিউজিকোলজিস্টদের (সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে সঙ্গীত শাস্ত্র অধ্যায়ন) মধ্যে যারা এই অঞ্চলের আকর্ষণীয় সংস্কৃতি নিয়ে পড়ালেখা করতে চান তারা বহুল প্রচলিত এই ভাষা শিখে নিজেদের পেশাগত জীবনে বিশেষ মাত্রা যোগ করতে পারেন।
সিএলএসের বাংলা কর্মসূচির হয়ে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বাংলা শিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ (লিজ) থমাস। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স ব্ল–মবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের ওই গবেষক বাংলা শেখার কারণ হিসেবে বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য বাংলাদেশে আসার আগ্রহের কথা মাথাই নিয়েই তিনি মাস্টার্স প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে অন্তত ছয় মাস থাকার পরিকল্পনা করেছিলাম। আর আমার প্রস্তাবিত গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় ভাষার প্রয়োজন ছিল।’
বাংলা শেখার সুযোগে লিজ থমাস তাঁর মাস্টার্সের গবেষণার জন্য সিলেট সফরের সুযোগের কথা জানান। তিনি বলেন, তিনি সত্যিই সিলেটে থাকতে এবং প্রকৃত জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তিনি বাংলায় কথা বলতে পারেন এবং তাঁর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টির ভালো মূল্যায়ন করে থাকে।
ঢাকায় পশ্চিমা কয়েকজন কূটনীতিকের কথা বলে জানা গেছে, এ দেশে আসার আগে দৈনন্দিন ব্যবহার করা হয় এমন কিছু বাংলা শব্দ বা সম্ভাষণ সম্পর্কে তারা ধারণা নিয়ে আসেন। অনেকে আবার এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা শিখেছেন। এ দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ রয়েছে বিদেশিদের।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী বিদেশি শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখার আগ্রহ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, রাশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, রুমানিয়া, নেদারল্যান্ড, জাপান, চীন, কোরিয়াসহ নানান দেশের লোকজন এখানে তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই বাংলা শিখছে। তারা তাদের পেশায় এটি কাজে লাগায়।
রূপা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষের আগ্রহ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা শিখে নিজ দেশে গিয়ে তাদের পেশাগত জায়গাতেও তারা দক্ষতা দেখাতে পারে। যেমন, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা চীনে গিয়ে বাংলা ভাষা পড়াচ্ছেন। চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাংলা ভাষা বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য নয়। তার অর্থ চীনারা বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আজ থেকে আগ্রহী নয়। ৪০-৫০ বছর আগে থেকেই তারা বাংলা ভাষা শিখছে।’
তিনি বলেন, যারা শিখেছে তারা বাংলাদেশেই শিখেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখেছে। এরপর তারা নিজ দেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা বিভাগ খুলে নিজেদের জনগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষা শেখাচ্ছে।
রূপা চক্রবর্তী বলেন, বিদেশিরা নানা কারণে বাংলা ভাষা শিখছে। তারা অনুবাদের কাজ করতে চায়। দোভাষীর কাজ করতে চায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়। এজন্য তাদের এখানকার স্থানীয় ভাষা শেখা দরকার। তাই তারা স্থানীয় ভাষা শিখবে বলে বাংলা ভাষা শিখে।
তিনি বলেন, এ দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অনেক বিদেশি, রুশ, চীনা, জাপানি কাজ করছে। হয়তো তাদের কেউ এখানে শ্রমিক, কেউ পরিদর্শকের কাজ করছে। কিন্তু তারা সবাই বাংলা ভাষা শিখছে। এটি শিখে তারা তাদের পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগাতে চায়।
রূপা চক্রবর্তী বলেন, বিদেশেও বাংলা ভাষা নিয়ে বড় বড় কাজ হচ্ছে। বিদেশিরা আকৃষ্ট হচ্ছে। তাই বাংলা ভাষা বৈশ্বিক গুরুত্বের জায়গায় পৌঁছেছে।
বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটেও বিদেশিরা বাংলা শিখছে। এ ছাড়া বিদেশিদের বাংলা শেখানোর আরো কিছু প্রতিষ্ঠানও আছে এ দেশে।
জানা গেছে, বাস্তবতার নিরিখেই উন্নত দেশগুলোর শিার্থীরা নিজ নিজ ভাষার পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষা শিখছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স বেশ ক’ বছর আগেই আমেরিকানদের বিদেশি ভাষা শেখাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিল। ওই কাউন্সিলের যুক্তি ছিল, বৈশ্বিক অর্থনীতি ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্ব থেকে সরে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সাল থেকে বৈশ্বিক জিডিপিতে ইংরেজি ভাষাভাষীদের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। ২০৩০ সালের পর চীনের অর্থনীতির আকার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়ও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অগ্রগতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করছে বিদেশি ভোক্তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ও সেবা বিক্রির ওপর। ওই ভোক্তাদের ইংরেজি ভাষাভাষী হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকনোমিক ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি অর্থনীতিই ক্রমশই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠছে। এ কারণে বিদেশি ভাষার চাহিদা ও গুরুত্ব বাড়ছে। ইউরোপীয় কমিশনের এক সমীায় দেখা গেছে, ইউরোপীয়দের বেশিরভাগই কর্মক্ষেত্রে একাধিকভাষা ব্যবহার করে। তাদের ৪৫%ই মনে করে, বিদেশি ভাষা জানার কারণে তারা নিজ দেশে ভালো চাকরি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টুডেন্ট ট্রাভেল প্ল্যানিং গাইড ম্যাগাজিনে বিদেশি ভাষার চাহিদা ও দক্ষতাবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের লোকজন সাত হাজারেরও বেশি ভাষায় কথা বললেও সবচেয়ে প্রচলিত হলো চীনা মান্দারিন, ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি, আরবি, বাংলা, রুশ, পর্তুগিজ, জাপানিজ, জার্মান ও ফ্রেঞ্চ। বিদেশি ভাষা হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে ওই ভাষাগুলোর চাহিদা একেকজনের কাছে একেক রকম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশাল জনগোষ্ঠী, বাজার এবং চীন ও ভারতের কাছাকাছি ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশকে আরো ভালো করে জানা ও চেনার উপায় হলো বাংলা ভাষা শেখা।