বৃহস্পতিবার রাত ২টা ১০ মিনিট। ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী রইসউদ্দিন আহমেদ নোমান মিনিট দশেক আগে পরীক্ষা শেষে হলরুম থেকে বের হয়। রাজধানীর ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে সে এবার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
কিন্তু এতো রাতে পরীক্ষা কেন এই প্রশ্নে তার জবাব, রাজনৈতিক নেতাদের কল্যাণে আজ মধ্যরাতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলাম। এজন্য নেতাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ওনাদের আশীর্বাদ ভবিষ্যতেও চাই, যাতে করে রাতে এভাবে আরও অনেক পরীক্ষা দিতে পারি।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮ দলের ডাকা হরতালের কারণে ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীদের বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় পরীক্ষা দিতে হয়। আর এই পরীক্ষা শেষ হয় রাত ২টায়। আর তাইতো নোমানের মুখে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গাত্মক কটুক্তি।
শুধু নোমান নয়, হরতালের কারণে তার মতো শত শত শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য হয়।
পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যখন বের হয় তাদের অনেকেই ঘুমে কাতর, শরীর জুড়ে ক্লান্তি। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও ক্লান্ত। কিন্তু ক্লান্তি তাদের ক্ষমা করবে না। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টায় তাদের আরেকটি পরীক্ষা। একইদিন বিকেল সাড়ে ৪টায়ও পরীক্ষা রয়েছে আরেকটি বিষয়ের।
বৃহস্পতিবারের হরতালের কারণে ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীদের বেলা সাড়ে ১১টার পরীক্ষা দিতে হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। আর বিকেল সাড়ে ৪টার পরীক্ষা দিতে হলো রাত ১২টায়। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে।
মধ্যরাতে পরীক্ষা যখন চলছিল তখন হলের বাইরে শতশত অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন বাইরে। এমনই একজন অভিভাবক ড. আরিফুর রহমান সিদ্দিক। তিনি একটি বিদেশি দূতাবাসে চাকরি করেন। সারাদিন অফিস করেছেন। অফিস শেষে বাসায় ফিরে একটু দম ফেলার ফুসরত পাননি। মেয়েকে নিয়ে ছুটে এলেন বসন্ধুরায়। মেয়েকে পরীক্ষার হলে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছেন রাস্তার ফুটপাতে।
হরতাল প্রসঙ্গে কথা উঠতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘গণতন্ত্রের বলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। নেতাদের হীন উদ্দেশ্যে চরিতার্থ পূর্ণ করতে আজ মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে। এই আমাদের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র চাই না।’
পাশেই বসে ছিলেন নিগার সুলতানা, ইসমত আরা ও লতিফা জহুর। লফিতা জহুর এসেছেন শাহজাহানপুর থেকে। পরীক্ষা দিচ্ছে তার মেয়ে। তিনি বললেন, ‘হরতাল থেকে মুক্তি চাই। ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। কিন্তু নেতাদের কারণে তাও সম্ভব না। আমরা কোথায় যাবো।’
ইসমত আরা জানান, হরতালের কারণে মধ্যরাতে পরীক্ষা দিতে এসে তার ছেলে ফাহাদ মোহাম্মদ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। জানি না ওর পরীক্ষা কেমন হয়। পরীক্ষা শেষে ফাহাদের সঙ্গে কথা হয় । পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইলে ফাহাদ জানায়, ভালো হয়নি।
বাসাবো থেকে মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছেন নিগার সুলতানা। তিনি জানালেন, বড় মেয়ে ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দিচ্ছে। ছোট মেয়ে দিচ্ছে ‘ও’ লেভেল। দুই সন্তানকে সামলাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর মধ্যরাতের পরীক্ষার কারণে তার বিন্দুমাত্র বিশ্রাম নেই।
তিনি বলেন, ‘যারা এসেছেন তাদের সবার ব্যক্তিগত গাড়ি নাই। এতো রাতে কিভাবে তারা বাসায় পৌঁছবেন। নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে পারবেন তো। পৌঁছলে আবার সকালে ঠিক সময়ে পরীক্ষার হলে আসতে পারবেন তো।’ এতোসব প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করেছেন নিগার সুলতানা।
সারা বছর ছেলেমেয়েরা কষ্ট করে প্রস্তুতি নিলো। অথচ শেষ মুহূর্তে এসে হরতালের কারণে যদি এভাবে কষ্ট পেতে হয় তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন ইসমত আরা।
আব্দুল্লাহ খালেদ নামে আরেক অভিভাবক বললেন, ‘সারাবিশ্বে এক যোগে ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। হরতালের কারণে এই পরীক্ষা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময়ের ব্যবধান হলে একজন শিক্ষার্থীকে আবার পরীক্ষা দিতে হবে। এজন্য যে পরীক্ষার ফিস দিতে হয়েছে তাও ফেরত পাওয়া যাবে না। মাঝখানে একজন পরীক্ষার্র্থীর জীবন থেকে ঝরে যাবে ছয়টি মাস। কিন্তু এ নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দলের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।’
ছেলের পরীক্ষার জন্য পুরান ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী সাঈদ লতিফের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলতে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলেন, ‘আপনাদেরকে বলে আর কি হবে। কিচ্ছু হবে না। এদেশ এভাবেই চলবে। কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই।’