মামা-ভাগ্নের দ্বন্দ্বে বন্ধের পথে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামে অবস্থিত দেশের বাণিজ্যিকভাবে একমাত্র কুমির চাষ প্রকল্প রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড।
সার্ক দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাণিজ্যিক কুমির চাষের এ খামারটি গত বছর জার্মানিতে ৬৭টি কুমির রফতানি করলেও মামা-ভাগ্নের দ্বন্দ্বের কারণে নতুন করে আর কুমির রফতানি হচ্ছে না এই ফার্ম থেকে।
শুধু তাই নয়, খামারটিতে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে অসংখ্য কুমির। এতে খাবার ও তাপ নিয়ন্ত্রণের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই এ ফার্মে দু-একটি করে কুমির মারা যাচ্ছে।
সরজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ২০০৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড এ খামার প্রতিষ্ঠা করে।
শুরুতেই খামারটিতে কুমিরের সংখ্যা ছিল ৭৫টি। পরে এসব কুমিরের ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটানো হয়েছে। বর্তমানে ফার্মে ছোটবড় মিলিয়ে ১ হাজার ২৫০টি কুমির রয়েছে।
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০০৪ সালের ৫ মে এ খামার প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়।
উদ্যোক্তারা পরে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সিআইটিইএস’র অনুমোদন নিয়ে মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আমদানি করে।
২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর কুমিরগুলো খামারে ছাড়া হয়। তখন আমদানি করা কুমিরগুলোর বয়স ছিল গড়ে ১০ থেকে ১৪ বছর। আর কুমিরগুলো লম্বায় ছিল ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১২ ফুট।
ফার্ম সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১০ সালে জার্মানিতে ৭০ লাখ টাকায় ৬৭টি কুমির বিক্রির মধ্য দিয়ে লাভের মুখ দেখে প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে কুমির রফতানির দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রথমবারের মতো নাম লেখায় বাংলাদেশ।
ওই খামারে মূলত লোনা পানির কুমিরই চাষ করা হয়।
খামারসংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জার্মানিতে কুমির রফতানির পরই কোম্পানির পরিচালক মুশতাক আহম্মেদ তার মামা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মেসবাহ উল হকের কাছে তার বকেয়া পরিশোধের দাবি জানান।
এতে মেসবাহ উল হক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে দেখা দেয় মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব।
দু’মালিকের দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বৈঠক হলেও আজও পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ খামারটি আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এ খামারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ, মেসবাহ উল হকের ৩৬ শতাংশ এবং মুশতাক আহম্মেদের ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
বর্তমানে খামারটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ দু’টির দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করছেন মেসবাহ উল হক। আর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মুশতাক আহম্মেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পৃথীশ কুমার।
আন্তর্জাতিক ক্রোকোডাইল স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য খামারের পরিচালক মুশতাক আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিজের অভিজ্ঞতা ও মেধা দিয়ে তিলে তিলে এ খামারটি গড়ে তোলার পর এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আর কুমির পালন অভিজ্ঞতাহীন খামারের চেয়ারম্যান মেসবাহ উল হকের মনগড়া সিদ্ধান্তের কারণেই খামারটি আজর ধ্বংসের পথে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে বিনা কারণে কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেই ভারপ্রাপ্ত এমডি’র পদ ব্যবহার করছেন মেসবাহ উল হক।’
মুশতাক আহম্মেদ আরও বলেন, ‘৫ কোটি টাকা দিয়ে আমার মালিকানার অংশও কিনে নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যান চাপ দিচ্ছেন। আমার সময়ে খামারে নিয়োগ পাওয়া সব বিশেষজ্ঞ, শ্রমিকদের চাকরি থেকে বরখাস্তও করেছেন তিনি। ফলে সুষ্ঠুভাবে খামারে কুমিরের খাদ্য ও পরিচর্যার অভাব দেখা দিয়েছে।’
তিনি জানান, ‘খাদ্য হিসেবে কুমিরকে মাছ ও মাংস দিতে হয়। অপরদিকে, ঠাণ্ডা থেকে রক্ষার জন্য পানিতে দিতে হয় ইলেকট্রিক তাপ। এসব ঠিকমতো না হওয়ায় প্রতিদিনই খামারের কুমির মারা যাচ্ছে। এছাড়াও চেয়ারম্যান খামারের প্রবেশপথের মূল অংশের জমি তার স্ত্রী মাহফুজা হক লুলুর নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন।’
এদিকে, উভয় পরিচালকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমার খামারটি পরিদর্শন করে নানা অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন।
ওই সময় তিনি ওই প্রতিবেদনে স্বীকার করেন, ‘ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে সম্ভাবনাময় এ খামারটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে। প্রায় এক বছর পরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে খামারটিতে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে ফার্মের চেয়ারম্যান মেসবাহ উল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘পরিচালক মুশতাক আহম্মেদ তার ভাগ্নে।’
দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘খামারটি বড় করার স্বার্থে অন্য বিনিয়োগকারী আনার প্রস্তাব করা হলে তিনি নিজেও কোনো অর্থ দিচ্ছেন না আবার অন্য বিনিয়োগকারীও নিতে দিচ্ছেন না।’
খামারে কোনো কুমির মারা যাচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে মুশতাক আহম্মেদ আরও অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সমস্ত নিয়ম কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফার্ম বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন মেসবাহ উল হক। বাংলাদেশ ব্যাংককে পুরো বিষয়টি বার বার জানানোর পরেও কোনো কিনারা না হওয়ায় তিনি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।’
তিনি মনে করেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ, তাই এতে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি ও খরচ আরও বাড়বে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এ ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে।’