৯১তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কার পুরস্কারের আসর বসবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে অস্কারের মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ হয়েছে। প্রথমবারের মতো অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে নেটফ্লিক্সের ছবি ‘রোমা’। মনোনয়ন পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেও, এতে থেমে থাকতে চায় না নেটফ্লিক্স। অস্কার জিতে নতুন ইতিহাস লিখতে উঠেপড়ে লেগেছে এই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট।
‘রোমা’ একটি স্প্যানিশ ভাষার চলচ্চিত্র। সেই হিসেবেও নতুন রেকর্ড গড়েছে আলফনসো কুয়ারন পরিচালিত এই ছবি। বিদেশি ভাষার ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চসংখ্যক ১০টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে ছবিটি। সেরা ছবি বিভাগের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগেও মনোনয়ন পেয়েছে রোমা। এক হিসেবে পরিচালকই এই ছবির প্রাণভোমরা। ছবিটি যে ১০টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে, তার মধ্যে চারটিই পরিচালকের কৃতিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরিচালনার পাশাপাশি আলফনসো কুয়ারনই এই ছবির প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও সিনেমাটোগ্রাফার।
বেশ কয়েক বছর ধরেই হলিউডের বক্স অফিসকেন্দ্রিক ছবির জন্য ধীরে ধীরে হুমকি হয়ে উঠেছে নেটফ্লিক্স। অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের এই ওয়েবসাইটে অনেক কম অর্থ খরচ করেই একজন গ্রাহক ঢুকে যেতে পারেন বিনোদনের এক বিশাল জগতে। সেখানে আছে নানা স্বাদের ছবি ও সিরিজের এক অতিকায় সংগ্রহ। সুতরাং একজন গ্রাহক যদি কম খরচে বেশি বিনোদন চান, তবে নেটফ্লিক্সের বিকল্প তাঁর সামনে নেই। ঠিক এই জায়গাতেই খাবি খাচ্ছে হলিউডের প্রথাগত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই একসময় তাঁরা বলতে শুরু করেছিলেন যে, নেটফ্লিক্সের ছবি শিল্পমানের দিক থেকে উন্নত নয়। এই অভিযোগ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হলেই, সমালোচকেরা বলতেন—এত ভালো হলে অস্কার পেয়ে দেখাও! এবার সেই চ্যালেঞ্জেই জয়ী হতে চাইছে নেটফ্লিক্স।
সেরা ছবির পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগেও মনোনয়ন পেয়েছে আলফনসো কুয়ারনের ‘রোমা’। ছবি: এএফপি
সেরা ছবির পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগেও মনোনয়ন পেয়েছে আলফনসো কুয়ারনের ‘রোমা’। ছবি: এএফপি
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অস্কারে মনোনয়ন পাওয়াকে ‘প্রাথমিক বিজয়’ হিসেবে বিবেচনা করছে নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ। অস্কার জিততেই মরিয়া তারা। রোমা ছবির সৌজন্যেই লড়াইয়ের মঞ্চে আসতে পেরেছে নেটফ্লিক্স। সাদাকালো এই ছবিটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ ছবিটির প্রচারেই ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে যুক্তরাষ্ট্রের এই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং কর্তৃপক্ষ! এ থেকেই আঁচ করা যায়, অস্কার জিততে আদাজল খেয়ে লেগেছে নেটফ্লিক্স।
‘রোমা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
‘রোমা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেরা ছবি হওয়ার লক্ষ্যে ছুটছে নেটফ্লিক্স। বলা হচ্ছে, রোমার জন্য অস্কার মৌসুমের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রচারাভিযান শুরু করা হয়েছে। একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে নেটফ্লিক্স। দেওয়া হচ্ছে ২০০ পৃষ্ঠার বই এবং হাতে তৈরি চকলেট। সিবিএস চ্যানেলের সকালের সংবাদ প্রচারের অনুষ্ঠানে রোমার বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার ডলার খরচ করছে নেটফ্লিক্স।
১৯৭০ সালের মেক্সিকোয় এক গৃহকর্মীর জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে রোমার কাহিনি। এই ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন মেক্সিকোর ইয়ালিটজা আপারিহিও। রোমার হয়ে কথা বলতে জনপ্রিয় হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগেই এক অনুষ্ঠানে আপারিহিওর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন জোলি।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, রোমা কতটুকু জনপ্রিয় হয়েছে—সেটি কেউ বলতে পারছে না! কারণ, অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে এই ছবি খুবই সীমিত আকারে অল্প সময়ের জন্য হাতে গোনা কয়েকটি সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কতজন দর্শক এই ছবি দেখতে পেরেছেন, তার সঠিক সংখ্যা কখনোই জানায়নি নেটফ্লিক্স। তাই সমালোচকদের প্রশংসা মিললেও, ছবিটি হিট হয়েছে নাকি ফ্লপ—তা বলার উপায় নেই।
এবারের অস্কারে নেটফ্লিক্সের বিভিন্ন ছবি ১৫টি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। অস্কার জেতার জন্য গত বছর কয়েক ধরেই বিখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে লগ্নি করছে নেটফ্লিক্স। সেই হিসাব থেকেই আলফনসো কুয়ারনের ছবিতে আগ্রহী হয় স্ট্রিমিং জায়ান্টরা। কারণ অস্কার জেতার অভিজ্ঞতা আছে কুয়ারনের। স্পেস থ্রিলার ‘গ্র্যাভিটি’ পরিচালনা করে ২০১৪ সালের আসরে সোনালি ট্রফিটি হাতে নিয়েছিলেন তিনি। সুতরাং তাঁকে বেছে নেওয়ার যুক্তিটা খুবই সহজ।
এর আগে ২০১৩ সালে এমি অ্যাওয়ার্ড জিততেও এভাবেই আগ্রাসী প্রচার চালিয়েছিল নেটফ্লিক্স। সেবার এই প্রতিষ্ঠানের তুরুপের তাস ছিল তুমুল জনপ্রিয় সিরিজ ‘হাউস অব কার্ডস’। ওই বছর একাধিক এমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছিল নেটফ্লিক্স।
‘রোমা’ ছবির একটি দৃশ্যে মেক্সিকোর অভিনেত্রী ইয়ালিটজা আপারিহিও। ছবি: সংগৃহীত
‘রোমা’ ছবির একটি দৃশ্যে মেক্সিকোর অভিনেত্রী ইয়ালিটজা আপারিহিও। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের বাজারে একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল নেটফ্লিক্স। এখন আর সেই অবস্থা নেই। আমাজন প্রাইম, ওয়ার্নার মিডিয়া, ডিজনির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান এসে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতে গ্রাহকদের ধরে রাখতে চাইছে নেটফ্লিক্স। একই সঙ্গে নতুন নতুন গ্রাহককে আকৃষ্ট করতেও এসব পুরস্কারকে ব্যবহার করতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
রোমা নিয়ে প্রচার তো চলছেই। এতেই থেমে যেতে চাইছে না নেটফ্লিক্স। এবার আরেক অস্কারজয়ী পরিচালক রন হাওয়ার্ডের দিকে হাত বাড়িয়েছে তারা। ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের অস্কার জিতেছিলেন রন। তাঁর নতুন ছবির জন্য ৪৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি হয়ে গেছে নেটফ্লিক্স। কথা রটেছে, পুরস্কার জেতার জন্যই প্রতিষ্ঠানটি কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢালতে কার্পণ্য করছে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অস্কার না জিতে থামবে না নেটফ্লিক্স। অস্কার যে তাদের চাই-ই চাই!