সদ্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি নেওয়া বর্তমান দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে দায়িত্ব দিলে আমি আবার রেলে ফিরবো।’
বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় জিগাতলার নিজ বাসভবনের আঙ্গিনায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘৫৫ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ৫৫ সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায় না। যেতেও পারে না। আমি গত মাসের ১৬ তারিখ সংবাদ সম্মেলন ডেকে রেলভবনে বলেছিলাম, তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আমি আবার রাজনীতিতে ফিরে আসবো। রেলের তদন্তে আমি প্রাথমিকভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। তাই আজ ১৬ মে আমি রাজনীতিতে ফিরে এলাম।’
তিনি বলেন, ‘এই একমাসে আমি কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে বক্তব্য দিইনি। আমি নিভৃতচারী ছিলাম।’
তাকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার সমালোচনা করে সুরঞ্জিত বলেন, ‘পত্রিকায় আমার সম্পত্তি নিয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। আমি তো সাতবারের এমপি। আমি ফকির (ভিখিরি) না।’
‘৪০ বছর আগে বিয়েতে যে খাট পেয়েছি সেটায় এখনও ঘুমাচ্ছি’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাসার রুমগুলোতো এসে দেখে যান আমার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন।’
‘মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে নজির সৃষ্টি করেছি’ বলে দাবি করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘সে নজিরের সাক্ষী আমি এবং সেদিন (১৬ এপ্রিল) উপস্থিত সাংবাদিকরা। অতীতে কোনো সরকারের মন্ত্রী পদত্যাগ করেনি আমিই করেছি। আমি সেদিন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়।’
সুরঞ্জিত তার পুত্র সৌমেন সম্পর্কে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে কানাডা থেকে এসেছে। সে চাইলে সেই দেশেই থাকতে পারতো। দেশ ও জনগণের কল্যাণে দেশে এসেছে।’
সুরঞ্জিত বলেন, ‘সে (সৌমেন) যে টেলিকমিউনিকেশন্স লাইসেন্স পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে তা সত্য নয়। সে ও তার বন্ধুরা মিলে এ লাইসেন্স পেয়েছে। তার নিজের পুঁজি মাত্র ৬০ হাজার টাকা। অথচ পত্রিকায় এসেছে পাঁচ কোটি টাকা নাকি আত্মসাৎ করেছেন সৌমেন, যা দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘সৌমেন মন্ত্রিপুত্র হিসেবে এককভাবে লাইসেন্স পায়নি। সে ও তার বন্ধুরা মিলে আবেদন করেছে এবং তা পেয়েছে।’
সুরঞ্জিত বলেন, ‘আমার পরিবার ও আমার দীর্ঘদিনের রাজনীতির ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য একটি মহল কাজ করেছে।’
এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া এবং এ সংক্রান্ত কেলেংকারির মুখে ১৬ এপ্রিল রেলভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন বলে ঘোষণা দেন বর্ষিয়ান এ রাজনীতিক। রেলভবনে আয়োজিত সেই সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত দাবি করেন, এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের অর্থ কেলেঙ্কারিতে কোনোভাবেই তিনি জড়িত নন। সেই সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেন, এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি নয়।
‘রাজনীতিতে এটা আমার যাত্রাবিরতি। আমি তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আবার ফিরে আসব,’ বলেও সেদিন মন্তব্য করেছিলেন সুরঞ্জিত।
এর আগে গত বছরের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। শপথ নেওয়ার পর ‘দুর্নীতির কালো বিড়াল’ খুঁজে বের করবেন বলে ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু পাঁচ মাস যেতে না যেতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সুরঞ্জিত নিজেই নাটকীয়ভাবে রেল মন্ত্রণালয়ের অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন।
এরপর সুরঞ্জিত ১৬ এপ্রিল মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে নাটকীয়ভাবে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে এখনো দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবেই আছেন তিনি।
সরকারি তথ্য বিবরণীতে ১৭ এপ্রিল জানানো হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ সালের (৩) এর ৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানপূর্বক দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।’
উল্লেখ্য, ৯ এপ্রিল রাতে মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে অর্থ পাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় গাড়িতে ওমর ফারুকের সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা কমানড্যান্ট এনামুল হক। ফারুকের গাড়িচালক ১০ এপ্রিল সকাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তার এই অন্তর্ধান রহস্যেরও কোনো কূলকিনারা এখনো হয়নি।
রেলওয়েতে নিয়োগ বাবদ ঘুষ হিসেবে পাওয়া ৭০ লাখ টাকাসহ তারা পিলখানা বিজিবি সদর দফতরের প্রধান ফটকে আটক হন। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে গাড়িটি রেলমন্ত্রীর বাসার দিকে যাচ্ছিল।
এদিকে এ ঘটনায় ১৫ এপ্রিল সুরঞ্জিতের নির্দেশে সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও কমানড্যান্ট এনামুল হককেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
অর্থ কেলেংকারির এ ঘটনায় ১৫ এপ্রিল রেলের মহাপরিচালক আবু তাহেরকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৩ মে রেলসচিব ফজলে কবীরের কাছে নিখোঁজ গাড়িচালক আলী আজমের বক্তব্য ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি। এটি এখন বর্তমান যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে রয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও রেলেওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বাংলানিউজকে একান্ত সাক্ষাৎকারে রোববার জানান, তদন্তে অর্থ কেলেংকারির সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। এছাড়াও রেলভবনে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকেও তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, ৯ এপ্রিল গাড়িটি সুরঞ্জিতের বাসায় যাচ্ছিল কি-না সে সম্পর্কে তিনি অবগত নন।