মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে বৃহস্পতিবারও জেরা করতে পারবেন আসামিপক্ষ। তবে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার মধ্যে জেরা শেষ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের-১ চেয়ারম্যান নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে গত তিনদিন ধরে ড. আনিসুজ্জামানকে জেরা করছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। বুধবার সকাল থেকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা শুরু করেন সাকা চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা। এক পর্যায়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত জেরা মুলতবি করা হয়।
দুপুর ২টার পর আহসানুল হক হেনা টানা জেরা অব্যাহত রাখলে প্রসিকিউশনের বুধবারের মধ্যেই জেরা শেষ করার আবেদনের প্রেক্ষিতে বারংবার ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষে সময় বেধে দেন। সর্বশেষ বিকেল ৪টা ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় নেন সাকার আইনজীবী হেনা। কিন্তু তিনি জেরা শেষ রে দিলেও অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম আবারো সময় প্রার্থনা করেন।
ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের জেরা মুলতবি করে শেষবারের মতো সময় দিয়ে বৃহস্পতিবর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার মধ্যে জেরা শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, সোমবার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন ড. আনিসুজ্জামান। সেদিন তাকে জেরা শুরু করেন সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। মঙ্গলবার জেরা শুরু করেন আহসানুল হক হেনা।
বুধবার আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা ড. আনিসুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যাকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে সাকা চৌধুরীর বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক তৎপরতা সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন। তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই শিক্ষাবিদকে তার ব্যক্তিগত ও শিক্ষকতা জীবন একাত্তরের ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা নিয়েও প্রশ্ন করেন।
আইনজীবী হেনা প্রশ্ন করেন, ড. আনিসুজ্জামান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তখন সাকা চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তা তিনি জানেন কিনা। জবাবে ড. আনিসুজ্জামান জানান, তিনি জানেন।
চট্টগ্রাম থাকাকালে ড. আনিসুজ্জামান প্রায়ই সাকা চৌধুরীর বাড়ি গুডস হিলে যেতেন বলে হেনা উল্লেখ করলে তিনি জানান, প্রশ্নই ওঠে না।
ড. আনিসুজ্জামান একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কবে গঠন করা হয় এবং তিনি এ কোন দায়িত্বে ছিলেন বলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে গঠিত হয় এবং তিনি এর সদস্য ছিলেন। ‘আপনারা কখনো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরে যুদ্ধাপরাধী বলে উল্লেখ করে বিচার চাননি’ এ প্রশ্নের উত্তরে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘১৯৯১ সালে যখন গণ-আদালত গঠিত হয়, তখন আমি গোলাম আযমের বিরু্দ্ধে অভিযোগকারী ছিলাম। গণ-আদালত গঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের উদ্দেশ্যে। সেখানে অন্য কারো বিষয়ে অভিযোগ-বিচারের সুযোগ ছিল না।’
উল্লেখ্য, সোমবার সাক্ষ্যদান কালে ড. আনিসুজ্জামান জানান, সাকা চৌধুরী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হয়ে কাজ করেছেন। এ সময় তিনি ‘পাকিস্তানি মেজর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সাক্ষ্যে তিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম তথা সারা দেশের ভীতিকর পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
দীর্ঘ সাক্ষ্যে আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্ভর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। আমি ’৭২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথমে খুলনায় এবং ৮ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব পদে যোগদান করে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করি।’
সাক্ষ্যে ড. আনিসুজ্জামান চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার পর আমি নূতন চন্দ্র সিংহের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য কুণ্ডেশ্বরীতে যাই। তখন তার কনিষ্ঠ ছেলে প্রফুল্ল চন্দ্র সিংহ আমাকে জানান, পাকিস্তানি সেনারা ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে। এসময় ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তখন তারা নতূন চন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে ফিরে যাওয়ার সময় সাকার ইঙ্গিতে পাকিস্তানি বাহিনী নূতন চন্দ্রকে টেনেহিঁচড়ে বাসা থেকে বের করার পর গুলি করে। পরবর্তীতে মূমুর্ষূ নতূন চন্দ্রকে সাকা চৌধুরী তার পিস্তল দিয়ে গুলি করে। এতে তার মৃত্যু হয়। প্রায় তিনদিন তার মৃতদেহ সেখানে পড়ে ছিল। পরে স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্যে তার সৎকার করা হয়।’
আনিসুজ্জামান তার সাক্ষ্যে আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে ’৭১ সালের কোনো এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালেহ উদ্দিনকে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। তাকে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদেরের বাড়ি গুডস হিলে আটকিয়ে রাখ হয়। সেখানে সাকা চৌধুরী ও অন্যান্যরা তার ওপর নির্মম অত্যাচার করে। সালেহ উদ্দিন পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় সিনেটের এক অধিবেশনে ওই অত্যাচারের কথা জানান। আমরা দেখেছি, তখনও তার শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন ছিল।’
‘অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন বর্তমানে সিলেটের শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য’ বলেও তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন ড. আনিসুজ্জামান।
এদিকে সোমবার সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাক্ষী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে কয়েক দফা ‘মিথ্যুক’ বলায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মঙ্গলবার তাকে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস জারি করেছেন। ব্যারিস্টার ফখরুলকে ২৭ মের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে এর জবাব দিতে হবে। অন্যদিকে সাক্ষ্যগ্রহণ কালে সোমবার সাকা চৌধুরী কয়েকবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় তাকে শেষবারের মতো সতর্ক দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ধরনের গোয়ার্তুমি অব্যাহত রাখলে তাকে ছাড়াই বিচার চলবে বলে আদেশ দেন আদালত।
এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য শেষ করেন, যা শুরু হয় গত ৩ মে।
উল্লেখ্য, একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন, ধর্মান্তরকরণসহ ২৩টি অপরাধের দায়ে ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
এ নিয়ে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সংঘটিত অপরাধের ঘটনা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে তিনজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ১৩ মে রোববার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট এই পাঁচ মাসে রাউজানসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় কমপক্ষে ৪৩৭ ব্যক্তির হত্যার সঙ্গে জড়িত সাকা চৌধুরী।
তার বিরুদ্ধে রাউজানের শাকপুরা, ঊনসত্তরপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। শুধু রাউজানেই ৯টি গণহত্যা চালানো হয়। মূলত, হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নিশ্চিহ্ন করতে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
বলা হয়, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট যে ২৩টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয় সেগুলোতে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন।
অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে সাকা চৌধুরীদের গুডস হিলের বাসভবনকে টর্চার সেন্টার করা হয়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। সাকার নিজের এলাকা রাউজানের ডা. নূতন চন্দ্র সিংহ ও মধ্য গহিরার ডা. মাখনলাল শর্মাসহ গহিরা বিশ্বাসপাড়া, জগৎমল্লপাড়া, ঊনসত্তরপাড়াসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৬ জুলাই সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে গ্রেফতারের জন্য ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে বনানীর একটি বাসা থেকে অপর একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এটি ছিলো হরতালের আগে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলা। পরে তাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতার দেখানো হয়।
২০১১ সালের ৪ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। ৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে ১ হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়।