অনাপত্তি ছাড়া আনোয়ারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা

অনাপত্তি ছাড়া আনোয়ারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা

পরিবেশ মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি ছাড়া আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে এই তিন কর্তৃপক্ষ অনাপত্তি দিলে বিদ্যুতের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে বলেও মতামত দিয়েছেন আদালত।

এ বিষয়ে জারি করা রুলের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন।

আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, এ বিষয়ে জারি করা রুল আদালত নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি ছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। তবে অনাপত্তি দিলে বিদ্যুতের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নির্মাণ করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘এখনো এই তিন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। ভবিষ্যতে যদি অনুমতি দেয় তাহলে পরিবেশের স্বার্থে আমরা আবার আদালতে যাবো।’

২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) এবিষয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত পারকি বিচ, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ বেস এবং বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আনোয়ারা থানার রাঙ্গাদিয়া মাঝেরচর মৌজায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এক লাখ ঝাউ গাছ না কাটার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে ওই রুল জারি করেন আদালত।

বিদ্যুৎ সচিব, পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রিট আবেদনকারীপক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার মেজবাহুর রহমান।

রুলের শুনানিতে মাহবুবে আলম বলেন, একই বিষয় নিয়ে তিনটি পক্ষ হাইকোর্টে পৃথক মামলা করেন। এসব মামলার কোনোটিতে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও আপিল বিভাগ তা স্থগিত করেছেন। তিনি বলেন, ওই সব মামলার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ কেন্দ্র যথাসময়ের মধ্যে করা না গেলে দেশ অন্ধকারে থাকবে। দেশের অনেক উন্নয়ন বিদ্যুতের কারণে থেমে আছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘ওই এলাকায় ৫০০ ফুট উ‍ঁচু চিমনি বসানোর ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকলেও আমরা কম উঁচু চিমনি বসাবো।’

তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের আবেদন করা হয়েছে। প্রকল্প প্রোফাইল এবং সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। এ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে আগে জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন। এজন্য পিডিবি ১১৫ কোটি টাকা চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বরাবরে ছাড় করেছে। জমি অধিগ্রহণ করা না গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘ভারতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ যাতে দূষণ না হয় সেজন্য উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটা হবে। দেশের স্বার্থে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়া দরকার।’

এর জবাবে রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদালতে বলেন, ‘এখনও পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দেয়নি। ভবিষ্যতে ছাড়পত্র না দিলে এখনও যে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ হবে তার পুরোটাই অপচয় হবে। তাই আগেই পরিবেশ অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নেওয়া হোক। সম্ভাব্যতা যাচাই করা হোক।’

তিনি জানান, সেখানে বিদ্যুত কেন্দ্র করা হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যাবে। এয়ারফোর্স বেসের কর্মকাণ্ডে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। এক লাখ গাছ কেটে ফেলতে হবে। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। চট্টগ্রাম নগরীর মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।

‘বর্তমানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে বছরে ৪০০ জাহাজ নোঙ্গর করতে পারে। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পর সেখানে আট শতাধিক জাহাজ নোঙ্গর করবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আর এটা হলে সমুদ্রবন্দরে জাহাজ জট লেগে যাবে। ঢাকায় যেমন যানজট হয়, তেমনি জাহাজ জট হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটবে। পারকি বিচের যে ক্ষতি হবে তা অর্থ দিয়ে পূরণ করা যাবে না।’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সরকারি প্রতিবদেনই স্বীকার করা হয়েছে সম্ভাব্যতা যাচাই আর প্রজেক্ট প্রোফাইল করা হয়নি। পরে এটা দেওয়া হবে বলা হচ্ছে। বিদ্যু‍ৎ কেন্দ্র করা হলে বিমানবন্দর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে করা হোক। যদিও সিভিল এভিয়েশন বলেছে, বিমানবন্দরের ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না।’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এলাকায় কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যু‍ৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ও পরবর্তীতে এটিএন নিউজে এসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত-সম্প্রচারিত হয়। এ প্রতিবেদনগুলো যুক্ত করে রিট আবেদন করা হয়।

বাংলাদেশ