রাজশাহী কিংসের সিইও প্রেসবক্সের পেছনে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে। স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন, ‘এই উইকেটে ১৪০ রান করলেই তো হয়। এত তাড়াহুড়ার কী দরকার ছিল!’ পাওয়ার প্লেতে ৩ উইকেটে ২৮ রানে তখন মুমূর্ষু তাঁর দল। তিনি তো আর জানতেন না ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইন আপে আজ প্রাণ এনে দেবেন এমন একজন, যিনি নিজেই ধুঁকছিলেন এবারের আসরে! আগের পাঁচ ইনিংসে ১০, ১*, ০, ২ ও ০ করা লরি ইভান্স কাল সেঞ্চুরির তিলক এঁকে দিয়েছেন এবারের বিপিএলে। তাতে ম্যাচের এক ভাগ জেতা কিংসের পূর্ণ পয়েন্ট নিশ্চিত করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। স্কোরকার্ডে ইভান্সের সেঞ্চুরিই সবচেয়ে নজরকাড়া। মাত্র ১০ রানে ৪ উইকেট নেওয়া কামরুল ইসলামও যথেষ্টই উজ্জ্বল। তবে ক্রিকেট রোমান্টিকদের কাছে মুস্তাফিজের বোলিংটাই বেশি দাগ কেটে থাকবে। ইনিংসের অন্তিমলগ্নে আফ্রিদির বিপক্ষে ৭টি ডট বল আর কে কবে কোথায় করেছেন? পাকিস্তানি মুগুরবাজ ব্যাট চালিয়েই গেছেন, কিন্তু বলের নাগাল পাননি। দ্বৈরথে কুমিল্লার বিপক্ষে রাজশাহীর ৩৮ রানের জয়ের চেয়ে আফ্রিদির বিপক্ষে মুস্তাফিজের জয়ের ব্যবধানটাও তাই মনে হচ্ছে বেশি।
৩.২-০-৮-১ বোলিং ফিগারে পর্যাপ্ত আকর্ষণ রয়েছে। তবে নিজের করা একটি ওয়াইডসহ ২১ বলের ১৩টিই মুস্তাফিজ করেছেন কুমিল্লার শেষ ভরসা হয়ে ক্রিজে আশা আফ্রিদি ও লিয়াম ডসনকে। অদ্ভুত স্ট্র্যাটেজিক লড়াই দেখা গেছে কাল মিরপুরে। মুস্তাফিজকে ঘিরে প্রতিপক্ষের ছক ফাঁকি দিতেই কিনা জিয়াউর রহমানকে প্রমোশন দিয়ে ডসনকে নামিয়ে দেয় ছয় নম্বরে। ওদিকে রাজশাহীর অধিনায়ক মুস্তাফিজের ৩ ওভার তুলে রাখেন ডেথের বিষে কুমিল্লাকে নীল করার জন্য। বৈধ ২০ বলের ১৪টি ডট নিয়ে ব্যাটিং সাম্রাজ্যের টি-টোয়েন্টিতে বোলারদের জয়গান গাইলেন মুস্তাফিজ। শুধু গতকালের ম্যাচই নয়, বিপিএলের শুরু থেকে যেন ফিরে আসছেন জনতার মুস্তাফিজুর রহমান। যাঁর স্লোয়ার, কাটারের দুর্বোধ্যতা নিয়ে রচিত মহাকাব্যে ধুলো জমতে শুরু করেছিল!
অবশ্য দিনশেষে সেরার পুরস্কার উঠেছে লরি ইভান্সের হাতেই। বিপিএলের প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছেন শৈশবে রাগবিতে মন দেওয়া এ ইংরেজ। সে-ও এমন একটা সময়ে যখন কিংসের ঊর্ধ্বতনরা মুণ্ডপাত করছিলেন ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতেই ইনিংসকে সর্বনাশের দোরগোড়ায় ঠেলে দেওয়া ব্যাটসম্যানদের। কুমিল্লার অফস্পিনার মেহেদী হাসানকে পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারি মেরে আশা জাগিয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। কিন্তু ওই ওভারের একটি বলের লেন্থ না বুঝে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়েছেন তিনি। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে আরো দুই উইকেট হারিয়েছে রাজশাহী, যার কোনোটির জন্যই বাড়তি কৃতিত্ব দাবি করতে পারবেন না কুমিল্লার বোলাররা। সে ‘অপরাধে’ই কি নিজের করা একমাত্র ওভারটিতে মাত্র ৪ রানে একটি উইকেট নেওয়া মেহেদী আর বোলিংই পেলেন না! জুটি ভাঙার জন্য কত কি চেষ্টা করেন অধিনায়ক। হতে পারে মেহেদীকে আক্রমণে আর না আনাই কুমিল্লার অধিনায়ক ইমরুল কায়েসের ‘চাল’ ছিল!
তাতে কাজ হয়নি। উল্টো তিন বিদেশির ওপর বোলিং নির্ভরতায় শেষ ৭ ওভারে ১০৬ রান গুনেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। শেষ ৪ ওভারে ৬৬ রান! শহিদ আফ্রিদির করা প্রথম ওভারে তিন বাউন্ডারি দিয়ে ইভান্সের রানযজ্ঞের শুরু। লিয়াম ডসনের বাঁহাতি স্পিনকে কিছুটা সমীহ অবশ্য করেছেন তিনি। নিজের প্রথম ওভারে মাত্র ২ রান দেওয়া ওয়াহাব রিয়াজকে পরের ৩ ওভারে গুনতে হয়েছে ৪২ রান। থিরাসা পেরেরা স্লোয়ার, ওয়াইড ইয়র্কার দিতে পারেন বলে মারমুখী পর্বে দলের ভরসাও। কিন্তু কিসের কী, এ লঙ্কানের ৩ ওভারেই যে উঠেছে ৪৩ রান। পেরেরার করা ইনিংসের শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে সিঙ্গেল নিয়ে নিজের এবং এবারের বিপিএল আসরের প্রথম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ইভান্স। ৬১ বলের সেঞ্চুরিতে ৮ বাউন্ডারি আর ৬ ছক্কা আছে তাঁর। সেঞ্চুরি করেও শান্ত ইভান্স, বাউন্ডারি দড়ির বাইরে থেকে ফটো সাংবাদিকদের পীড়াপীড়িতেই সম্ভবত অনিচ্ছা থেকে ব্যাটটা তুললেন একবার। অসমাপ্ত ইনিংস তো আর উৎসবের উপযুক্ত সময় নয়। তখনো বাকি ৪ বল। ওভারের প্রথম বলে প্রান্ত বদল করে ব্যক্তিগত পঞ্চাশ পূর্ণ করা রায়ান টেন ডশাটে স্ট্রাইকে। এ ডাচ ক্রিকেটার পেরেরার পরের তিন বলে এক ছক্কায় ৯ রান তোলার পর আবার স্ট্রাইকে লরি ইভান্স। রাজশাহী ইনিংসের শেষ বল। পেরেরা ওয়াইড ইয়র্কারের চেষ্টাই করেছিলেন, কিন্তু তার আগেই পজিশন নেওয়া সেঞ্চুরিয়ানের ব্যাট হয়ে বল বুলেটের গতিতে ছুটে গেছে কাভার বাউন্ডারিতে। লরি ইভান্সের ব্যাটিংয়ে যাঁরা এত দিন এবি ডি ভিলিয়ার্সের ছায়া দেখতেন, গতকালের পর তাঁরা এ ধারণা প্রচারণার পক্ষে যথেষ্ট মনোবল পেয়ে থাকবেন!
অবশ্য মনোবলে তো উড়ছে রাজশাহী। দলবদলের পর কোথাও থেকে তেমন সমীহ মেলেনি। অথচ অদম্য ঢাকা ডায়নামাইটসকে প্রথম হারের স্বাদ দিয়েছে রাজশাহী কিংস। ৭ ম্যাচে চতুর্থ জয়ে পয়েন্ট তালিকার চার নম্বরে বসে দলটি নিচে তাকালেই দেখতে পাচ্ছে গতবারের চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্সকে। তাহলে তো আর বড় আসরে ছোট দল নেই রাজশাহী কিংস!