ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কে এই মুহুর্তে অস্বস্তির কেন্দ্রে আছে যে তিস্তা নদী, সেটি ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই বলে বিবিসির কাছে দাবি করেছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং। তিস্তা নদীর উৎপত্তি ভারতের পার্বত্য অঙ্গরাজ্য সিকিমেই, আর সিকিম তিস্তার ওপর একের পর এক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার ফলেই এই নদীর প্রবাহ ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে বলে বহু পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মনে করে থাকেন।
বস্তুত ‘তিস্তায় একেবারেই পানি নেই’ – এই যুক্তি দেখিয়েই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন।
সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী মি চামলিং বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বানিয়েছি তাতে নদীর পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি বললেই চলে।’
তিনি আরও দাবি করেছেন, সিকিম এতটাই দায়িত্বশীলভাবে তিস্তার ওপর বিভিন্ন জলধার ও বাঁধ নির্মাণ করেছে যে তাতে গোটা রাজ্যের মাত্র ৭টি পরিবারকে আশ্রয়চ্যুত হতে হয়েছে। তিস্তার ভাঁটিতে যে সব অঞ্চল রয়েছে (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) তাদের উদ্বেগের প্রতিও সিকিম সব সময় খেয়াল রেখে চলছে বলে মুখ্যমন্ত্রী চামলিং ওই সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন।
যদিও তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন, কারণ একটি ‘আন্তর্জাতিক বিষয়’ নিয়ে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী যাই বলুন, বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন ওই রাজ্যের অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
তিস্তার প্রবাহ পর্যালোচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে কমিশন গঠন করেছিল, তার প্রধান ও নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র যেমন পরিষ্কার বলেছেন, ‘এই প্রকল্পগুলোর জন্যই তিস্তায় ‘লঙ্গিচিউডিনাল ডিসকানেক্টিভিটি’ তৈরি হয়েছে – সোজা কথায় নদীটা জায়গায় জায়গায় একেবারে শুকিয়ে গেছে! নদী মানেই কিন্তু শুধু পানির প্রবাহ নয় – তার সঙ্গে সেডিমেন্ট লোড থাকে। যখনই সেই নদী আটকে আপনি হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট গড়বেন, নদী প্রথমেই সেই সেডিমেন্ট লোডটা সেখানে ফেলে দেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আর তারপর কনডুইটের মধ্যে নিয়ে গিয়ে টার্বাইনে ঘোরানোর পর যে পানিটা আবার নিচে মেশানো হবে, ততক্ষণে তার অনেক গুণগত পরিবর্তন হয়ে গেছে – ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারগুলো বদলে গেছে। বায়োডাইভার্সিটিরও প্রচুর ক্ষতি হবে – কারণ নদীর প্রবাহে যে সব প্রাণ বেঁচে থাকে, তারা কখনও স্থির পানিতে বাঁচতে পারে না।’
কল্যাণ রুদ্রর মতে, ঠিক এই কারণেই তিস্তাকে দেখলে এখন বোঝা যাবে কেন এই নদীর প্রবাহে জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন বাঁধের ঠিক নিচে নদীটা প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। মোট ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য তিস্তার, তার সিকিম অংশে ‘মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যায়’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘সাড়ে ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তিস্তা অববাহিকার – তার মধ্যে সিকিমের অংশ খুবই টেকটোনিক্যালি ফ্র্যাজাইল, অর্থাৎ ভূমিকম্পের সম্ভাবনা খুবই বেশি। এরকম একটা অঞ্চলে এতগুলো হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট করা একেবারেই উচিত হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।’
তবে তিস্তা নিয়ে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এই বিতর্ক আলাদা মাত্রা পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে, কারণ তিস্তার প্রবাহ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন তার সঙ্গে মি চামলিংয়ের বক্তব্য একেবারেই মিলছে না। এই পটভূমিতে বাংলাদেশ কিন্তু এখনও চাইছে যত দ্রুত সম্ভব ভারতের সঙ্গে তাদের তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন।
তিস্তাতে হয়তো পর্যাপ্ত পানি নেই, ঢাকাও এই বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাদের বক্তব্য হল, ওই নদীতে যতটুকুই পানি থাকুক সেটা দুই দেশের মধ্যে আধাআধি ভাগ হওয়া দরকার। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চুক্তির জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিস্তায় আট আনা পানি থাকলে চার আনা-চার আনা ভাগ হবে, আর ছয় আনা থাকলে দুই দেশে তিন আনা-তিন আনা করে পাবে – এটা নিয়ে তো কোনো বিতর্ক থাকতেই পারে না!’
এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সদ্যই টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে তৎপরতা বাড়বে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। নতুন সরকারের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনও ভারতের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের আমন্ত্রণে আগামী মাসেই ভারত সফর করবেন বলে কথা রয়েছে।
যদিও এটাকে মূলত সৌজন্য সফর হিসেবেই দেখা হচ্ছে, তার পরেও সেই সফরে অবধারিতভাবেই তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হবে বলে কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে।