সরকারি হাসপাতাল নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর এক বছর আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তার খেসারত দিতে হলো নিরীহ এক শ্রমিকের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্মাণাধীন হাসপাতালের মূল ভবন ধসে পড়ে মারা গেছেন বজলুর রহমান নামের এক শ্রমিক। ভবন ধসে চাপা পড়ে আরো চার শ্রমিক এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
ঘটনাটি দক্ষিণের জনপদ কুষ্টিয়ার। কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের হাউজিংয়ের বিপরীতে নির্মাণ করা হচ্ছে কুষ্টিয়াবাসীর বহু প্রত্যাশিত কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কম খরচে সঠিক ও উন্নত সেবা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গেওই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। উল্টো হাসপাতাল ভবনের তৃতীয় তলার ছাদ ধসে কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন শ্রমিক বজলুর রহমান।
যে হাসপাতাল থেকে কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছিলেন বজলুর রহমান, সে হাসপাতালের ভবন ধসেই মর্মান্তিক মৃত্য হলো তাঁর। ঠিকাদারের খামখেয়ালি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ল এই দিনমজুরের পরিবার।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের পর কেন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি তা দেখতে গত বছর মাঠপর্যায়ে সরেজমিন পরিদর্শনে যায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ওই সময়কার পরিচালক ডা. আখতারুজ্জামানসহ একটি প্রতিনিধিদল। পরিদর্শন শেষে তিনি এই প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা একনেকে অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ভবন নির্মাণ করছে। একই সঙ্গে দর বাড়িয়ে কার্যাদেশ নেওয়া হয়েছে। সব কটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে আইএমইডি বলেছে, বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমোদন না নিয়েই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, যা ক্রয় আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’। অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মাঝখানে কিছু সময় বরাদ্দও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গতকাল যে ভবনটি ধসে পড়ে, সে ভবন নির্মাণেও অনিয়ম খুঁজে পায় আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হাসপাতাল ভবনের এক লাখ ৫৫ হাজার বর্গফুট ভিত্তির পরিবর্তে করা হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার বর্গফুট, যা অনুমোদিত নকশার চেয়ে ১৭ হাজার বর্গফুট কম। নকশায় হাসপাতাল ভবনটি ১০ তলা ভিত্তির ওপর সাততলা নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়েছে ১০ তলা ভিত্তির ওপর তিনতলা। গতকাল তৃতীয় তলার ছাদই ধসে পড়ে। এ ভবনের জন্য ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৯২ কোটি টাকার চুক্তি হয়।
জানতে চাইলে গতকাল রাতে ডা. আখতারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি সরেজমিন গিয়ে প্রকল্পটিতে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দেখতে পাই। ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে। আমি আমার প্রতিবেদনে সেসব কথা উল্লেখ করেছি। তখন যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে আজ এত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না।’
আইএমইডির ভারপ্রাপ্ত সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেকোনো প্রকল্পের গুণগত মান নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব আইএমইডির। কুষ্টিয়ায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তা সরেজমিন দেখতে আমি আমার সংশ্লিষ্ট শাখার মহাপরিচালককে দ্রুত পাঠাব। তারপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
এলাকাবাসী জানিয়েছে, নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এক ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বজলুর মৃহদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁর বাড়ি কুমারখালী উপজেলার চড়াইকোল গ্রামে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৪০ বর্গফুট আয়তনের তৃতীয় তলার ওই ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছিল। ঢালাইয়ের শেষ দিকে বিকেল সাড়ে ৪টায় হঠাৎ পুরো ছাদটি ধসে পড়ে। নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানায়, নির্মাণাধীন হাসপাতালের মূল ভবনের তৃতীয় তলার ৫০ ফুট বাই ৩০ ফুট ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছিল। ছাদটি মাটি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে। ঢালাইয়ের সময় নিচে স্টিলের পাইপের পরিবর্তে বাঁশের খুঁটি দিয়ে শাটারিং দেওয়া হয়েছিল। ফলে ভার সইতে না পেরে কয়েক টন ওজনের ছাদটি ধসে পড়ে।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক ফিরোজ কুতুবী জানান, নিম্নমানের দুর্বল জোড়াতালি দেওয়া বাঁশের খুঁটির ওপর ভর দিয়ে এই বিশাল স্থাপনার ঢালাই চলছিল। এ ছাড়া জয়েন্ট রডে কোনো ওয়েলডিং ছিল না। এ কারণে ভবনের ওই অংশের ছাদটি ধসে পড়েছে। ভবনের ধসে পড়া স্তূপের নিচ থেকে এক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এত বড় অনিয়মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার ছাদ ঢালাই কেন এত জোড়াতালি দিয়ে হচ্ছিল, আর অফিসাররা সেটা কেন মেনে নিয়ে চুপ করে ছিলেন? আমরা আইনের আশ্রয় নিব।’
এ ব্যাপারে গণপূর্ত সার্কেল কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী এ জে এম শফিউল হান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা কারণে অনেক দিন বিরতির পর সম্প্রতি আবার এখানে বিভিন্ন ধরনের কাজ চলছিল। কোনো ঢালাইয়ের আগে ঠিকাদারের লোকজনের আমাকে অবহিত করার কথা। কিন্তু তারা আমাকে কোনো রকম ইনফরমেশন না দিয়ে এই ঢালাই দিচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর আমি খবর পেয়ে এখানে আসি। এ ব্যাপারে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব।’
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, এই দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই প্রকল্পে বালি ভরাট কাজে ইতিমধ্যে প্রচুর টাকা ব্যয় হয়েছে বলা হলেও প্রতিটি ভবনের মাঝে বিশাল বিশাল গর্ত হয়ে আছে ভরাট না করায়। শুধু ভবনের অংশটুকুতেই বালি আছে আর সব গর্ত। এই প্রকল্পের কোনো সীমানা দেয়াল এখনো পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি। নেওয়া হয়নি কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প অনুমোদনের সময় মাটি ভরাট ও সীমানা দেয়াল অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে স্থানীয়রা বলছে, নকশা পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় এই প্রকল্পের কাজ থেমে গেছে। নির্মাণকাজ শুরুর পর প্রকল্পটির মেয়াদ দুইবার বাড়িয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। কবে নাগাদ এই প্রকল্প শেষ হবে তাও কেউ বলতে পারছে না।
২০০৮ সালে তৈরি করা প্রকল্পে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস নির্মাণ সম্পন্ন করতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এরপর দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালের জুলাই থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু করলে ওই বছরের ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রথমে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এবং পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পুরো প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে মূল ক্যাম্পাসে মেডিক্যাল কলেজ স্থানান্তর বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্প শুরুর পরপরই প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান, কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের সাবেক একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও দুজন এসডিই কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে অনিয়মের মাধ্যমে বহু টাকা নয়ছয় করেছেন। এর কারণে প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহিরুল ইসলামের মালিক জহিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। অপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজের মালিক এস এম শামীম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাজে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। তবে বিল না পাওয়ায় আমরা দু-একটি কাজ সমাপ্ত করতে পারিনি।’
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। ২০০৮ সালের অনুমোদিত প্রকল্পে ২০১৩ সালে কাজ করার সময় স্বাভাবিকভাবে অনেক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজ চলছে তবে গতি তুলনামূলক কম।
এসব বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী এ জে এম শফিউল হান্নান কালের কণ্ঠকে জানান, কুষ্টিয়াবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং দ্রুত কাজ করার জন্য অনেক কিছু অনুমোদন না করেই কাজ শুরু করা হয়েছিল যে পরে অনুমোদন নেওয়া হবে এই আশায়। এটুকুই অনিয়ম। অনিয়ম মানে এই নয় যে ছয়তলা ভবনের টেন্ডার করে চারতলা করা হয়েছে।