সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার প্রথম সাক্ষী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আদালতকে বলেছেন, বিএনপির এই সাংসদের সহায়তায় একাত্তরে চট্টগ্রামে রাউজানে হত্যা-নির্যাতন চলে।
আনিসুজ্জামানের জবানবন্দি শোনার মধ্য দিয়ে সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্য শেষে তার জেরা শুরুর পর মঙ্গলবার পর্যন্ত তা মুলতবি করেছে আদালত।
সাক্ষ্য ও জেরা চলার সময় দুই পক্ষের বাক বিতণ্ডায় বেশ কয়েক দফা আদালত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সালাউদ্দিন কাদের একাধিকবার উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি আদালতকে বলেন- ‘ডোন্ট শো ইউর রেড আইজ’।
এই পরিস্থিতিতে আদালত মুলতবি করার আগে একটি আদেশ দেন ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক। তিনি বলেন, সালাউদ্দিন কাদেরকে শেষবারের মতো সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে- যাতে তিনি তার আইনজীবীর অনুপস্থিতে আর জেরার সময় কথা বলার চেষ্টা না করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার জবানবন্দিতে জানান, একাত্তরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলে রামগড়ে তার সঙ্গে দেখা হয় কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় ও কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও নূতন চন্দ্র সিংহের ছোট ছেলে প্রফুল্ল চন্দ্র সিংহের সঙ্গে। প্রফুল্লের কাছেই আনিসুজ্জামান জানতে পারেন, নূতন চন্দ্র আর নেই।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে রাউজানে গিয়েও ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারেন আনিজ্জামান। গ্রামবাসী তাকে জানায়, সালাউদ্দিন কাদেরই পাকিস্তানি সেনাদের কুণ্ডেশ্বরীতে নিয়ে যায়। তার ইঙ্গিতেই গুলি করে হত্যা করা হয় নূতন চন্দ্রকে। ফিরে যাওয়ার সময় সালাউদ্দিন কাদের নিজেও গুলি করেন।
সাক্ষ্য শেষে সালাউদ্দিনের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম জেরা শুরু করেন আনিসুজ্জামনকে। এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, দেশভাগের পর আনিসুজ্জামানের পরিবার কেন ভারত থেকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল।
বিচারপতি নিজামুল হক এ সময় বলেন, এ ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না। তখন সাকা চৌধুরী চিৎকার করে দাবি করেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
এরপর ব্যারিস্টার ফখরুল জানতে চান, আনিসুজ্জামানরা ঠিক কবে ‘শরণার্থী হিসাবে’ পূর্ব পাকিস্তানে আসেন?
জবাবে ৭৫ বছর বয়সী আনিসুজ্জামান বলেন, সেই সময় (১৯৪৭ সালের পর) যারা ভারত থেকে পাকিস্তানে এসছিলেন, তাদের সাধারণভাবে শরণার্থী বলা হলেও তিনি বা তার পরিবার কখনো শরণার্থী হিসাবে কোনো সুবিধা নেননি।
আনিসুজ্জামান কবে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন- আইনজীবীর এমন প্রশ্নের পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, নির্দিষ্ট আইনেই সে বিষয়টির নিস্পত্তি হয়েছিল, কাজেই এ নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই।
এ পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের আবারো দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করেন এবং নিজেই সাক্ষীকে জেরা করার দাবি জানান। বিচারপতি নিজামুল হক তাকে জানান, আইনজীবী থাকা অবস্থায় তিনি তা পারেন না।
এরপর দুই জনের বাক্য বিনিময়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের বলে ওঠেন, “স্যার প্লিজ ডোন্ট শো ইউর রেড আইজ। আই রিকোস্ট ইউ উইথ অল রেসপেক্ট অ্যান্ড হিউমিলিটি।”
এমন পরিস্থিতিতে জেরা মুলতবি করে আদেশ দেন নিজামুল হক। আদেশে বলা হয়, “আইনজীবী নিয়োগ থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি কখনোই কাঠগড়া থেকে কথা বলতে পারেন না। আমরা শেষবারের মতো সতর্ক করলাম। তিনি (সাকা চৌধুরী) যদি এ রকম করতেই থাকেন, তাহলে তাকে ছাড়াই বিচার কাজ চলবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। ১৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৪ অক্টোবর এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল।
একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন, ধর্মান্তরকরণসহ ২৩ ধরনের অপরাধে অভিযোগ গঠনের পর গত ৩ মে সাক্ষ্য গ্রহণে প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়।