সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে যে জনপদ তাতে বসবাসকারীরা জীবন ও জীবিকার জন্য কত-কীই না করেন। তবে বিশাল সুন্দরবনই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। ঝড়-ঝঞ্ঝায় তারা বার বার হন সর্বশান্ত আবার গড়ে তোলেন নতুন জীবন। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে জীবনের সাথে টিকে থাকেন মানুষগুলো। শত বিপদে তারা সব হারান কিন্তু হারান না মনোবল। সাতক্ষীরার শ্যামনগর এই সুন্দরবনঘেঁষা একটি জনপদ। প্রথম দিনেই দেখা পেয়ে যান বাঘের থাবা থেকে বেঁচে আসা একজন আইয়ুব আলীকে। সেই আইুবকে নিয়েই সচিত্র প্রতিবেদন: ‘বাঘের চেয়ে সাহসী একজন আইয়ুব’
শ্যামনগরের (সাতক্ষীরা) গাবুরা গ্রাম থেকে: মাস খানেক আগের ঘটনা। কাঁকড়া ধরার উদ্দেশ্যেই সুন্দরবনের গহীনে যান আইয়ুব। সঙ্গে বড় ভাই বেলাল। এক সপ্তাহের রশদ নিয়ে সুন্দরবনের খাল ধরে এগিয়ে চলেন বনের গহীন থেকে গহীনে। তবে তৃতীয় দিনেই দুই ভাইয়ের বাড়ির জন্য অস্থির হয়ে ওঠে মন। দুভাই আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন সেদিন জাল পেতে যতটুকু কাঁকড়া পাওয়া যায় তা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাঁকড়ার অবস্থান আছে এমন একটি খাল দেখে জাল ফেলেন দুই ভাই। খাল বরাবর জালটিকে লম্বা করে ফেলে এরপর ভাটার জন্য অপেক্ষা।
শব্দটি প্রথম আইয়ুবের কানেই আসে। চেনা শব্দ, অভিজ্ঞ কান। বেলালকে বললেন ‘ভাইরে বাঘ আসতেছে’। এই বাঘ সুন্দরবনের ঐতিহ্য মানুষ ঘেকো বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটির কথাই বাংলানিউজকে বলছিলেন আইয়ুব।
বললেন, “মুখের কথা শেষ না হতেই সামনে চলে আসে বাঘ।”
জানালেন, ভয়কে সংবরণ করে দুভাই হাতের বৈঠা দিয়ে পানিতে শব্দ করতেই পথ ঘুরে চলে যায় বাঘটি।
পানিতে শব্দ করে বাঘ তাড়ানোর অভিজ্ঞতা তাদের আগেও ছিলো। বনে যারা কাজ করে উপরের বর্ণনা তাদের কাছে এটি প্রায় নিত্য দিনের চর্চা।
কিন্তু সেদিনের ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দুমিনিটের মধ্যে যখন বাঘটি আবার ফিরে আসে তখন বেশ অস্বাভাবিকই লাগে তাদের কাছে। এবারও বৈঠা দিয়ে পানিতে তৈরি শব্দ ও দুভাইয়ের চিৎকারে আবারও চলে যায় বাঘটি।
কিন্তু এবার আর নিশ্চিন্ত হতে পারেন না তারা। নৌকাটিকে একটু উপরে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় ভাই বেলাল বৈঠা হাতে এগিয়ে যান। নৌকার মাঝামাঝি একটা কুড়াল হাতে দাঁড়িয়ে আইয়ুব। ভাবছিলেন কি করা যায়। কিন্তু ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পান বাঘ আবারও এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।
সাহসী আইয়ুবের শক্ত হাতে কুঠার ধরা। মনে মনে ভাবছেন আসুক! কুড়াল দিয়ে ওর মাথা ভাঙব।
কিন্তু আইয়ুবকে সুযোগ না দিয়ে প্রায় ১৫ হাত দূর থেকে লাফিয়ে আইয়ুবের উপরই ঝাপিয়ে পড়ে বাঘটি।
ভাইয়ের চিৎকারে বেলাল ফিরে তাকান। ততক্ষণে তার ছোট ভাইটিকে নৌকার মাঝে ফেলে বাঘটি তার উপর চড়াও হয়েছে। বেলাল বুঝে ফেলে আদরের ভাইটিকে চোখের সামনেই হারাতে হচ্ছে। দিগি¦দিকশূণ্য হয়ে পড়েন তিনি।
সম্বিত ফিরে পায় আইয়ুবের চিৎকারে। ‘ভাই বাড়ি মার। বাড়ি মার ভাই!’
এবার বেলাল যেন নিজের হাতে থাকা বৈঠার অস্তিত্ব টের পান। ভাইয়ের কথা মতই বৈঠা দিয়ে আঘাত করেন বাঘটির মাথায়।
কিন্তু এক আঘাতেই দু’ভাগ হয়ে যায় বৈঠা। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি।
তখনও যুদ্ধ চলছে বাঘ ও বাঘের চেয়ে সাহসী আইয়ুবের সঙ্গে। বুদ্ধি করে নিজের পা দিয়ে বাঘের দুটি পা নৌকার বাইরে ঠেলে দিলেন তিনি। বেলালের আঘাত ও আইয়ুবের প্রতিরোধে বাঘটি আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। আইয়ুবের পিঠ থাবায় চেপে গলাটিকে নিজের দাঁতের মাঝে আনার চেষ্টায় মরিয়া তখন।
এদিকে আইয়ুব নিজের মাথাটিকে রক্ষা করতে হাতের কনুই উঁচু করে ধরেন। বাঘের কামড় বসে যায় সে কনুইয়ে।
জীবন মরনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তখনও আইয়ুবের চিৎকার, “মার ভাই, মার”। এবার কুড়ুল (কুঠার) দিয়ে মার।
এবার বেলালের চোখ পড়ে বাঘ আর আইয়ুবের লড়াইস্থলের পাশেই পড়ে থাকা কুঠারের দিকে।
সমস্ত ভয়কে ভুলে সেটা হাতে নেন বেলাল। আঘাত করেন বাঘের মাথা বরাবর। প্রথম আঘাত লাগল কিনা বোঝার আগেই হানেন দ্বিতীয় আঘাত।
এবার সত্যি আঘাত পায় বাঘটি। আইয়ুবকে ছেড়ে নিজের ফেরার পথ ধরে সে।
শেষ হয় বাঘের সঙ্গের যুদ্ধ। প্রাণ ফিরে পান দুই ভাই।
কিন্তু এরপর যে যুদ্ধ শুরু করেন আইয়ুব তা শেষ হয়নি আজো।
বাঘের হামলায় আহত ভাইকে নৌকায় নিয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকেন বেলাল। বাঘের দাঁতের আঘাতে ফুটো হওয়া বেলালের হাত থেকে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। প্রায় সাত ঘন্টা পর তারা পৌঁছান বুড়িগোয়লিনী বাজারে। অন্যান্য জেলেদের কাছে থাকা মোবাইলের মাধ্যমে তার পরিবার খবর পেয়ে সেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে রাখে আগে থেকেই।
থানা শহর শ্যামনগরে যখন বেলাল তার ভাইকে নিয়ে পৌঁছান তখন রাত সাড়ে আটটা।
রাতে শ্যামনগর থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিয়ে আইয়ুবকে পাঠানো হয় সাতক্ষীরা শহরের একটি কিনিকে। কিন্তু সেখানে সাত দিনে খরচ হয়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। পুরোটাই ধার করে আনে তার পরিবার। আর সম্ভব নয় এমন ভেবে সাত দিন পর বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। বাড়িতেই এখন তার চলছে কবিরাজি চিকিৎসা।
আইউবের মা জানান, কিনিক থেকে আনার পর প্রচুর ফুলে ওঠে আইয়ুবের হাত।
কবিরাজের মতে, পচন ধরেছে ক্ষতস্থানে। সে স্থানের মাংস ফেলে দিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। বাঘের দাঁতের আঘাতে আইয়ুবের হাতের শিরা বলতে কিছু নেই। হাতের হাড়টিও এমনভাবে ভেঙেছে যে সেটা হয়ত আর কখনো সোজা হবেনা। পরিস্কার করার প্রয়োজনে বাম হাত দিয়ে ধরে আঘাতপ্রাপ্ত হাতটি মাঝে মাঝে উঁচু করে ধরেন তিনি। নিজের ঘরের বারান্দায় শুয়ে কাটে আইউবের সময়।
‘সারারাত যন্ত্রনায় ঘুমুতে পারিনা’- বলেন আইউব। ‘পচন ধরার পর গন্ধে কেউ কাছে আসতে চায় না। নিজের ছেলেডাও কেমন পর হয়ে যাচ্ছে। কাছে আসতি ভয় পায়।’ ক্ষীণ কন্ঠে বলেন আইউব।
বাঘে ধরার পর সরকারি কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব আইয়ুবের পাশে বসে থাকা তার অসহায় মা মনোয়ারা বলেন, ‘সরকারি সাহায্য কি জিনিস তাই জানি না।
ঘূর্ণীঝড় আইলায় সব হারানো একটি পরিবার আইউবদের। সে ঝড়ের পর সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছইু পায়নি তাদের পরিবার।
মনোয়ারা জানালেন, ছেলেরা বনে গিয়ে কাঁকড়া ধরে খানিকটা অবস্থার উন্নতি করতিছিলো। কিন্তু এখন কি ওর চিকিৎসা খরচ আর সংসার কি করে চালাচ্ছি তা আমরা জানি। কদিন পর ওর চিকিৎসার জন্য আমাকে পথে বসতে হবে।
নিজের সংসারের বর্ণনা দিয়ে মনোয়ারা বলেন, “১১ জনের সংসার। সবার পেট ওই বনের ওপর চলে। সেখানে না গিয়ে উপায় কি!”
মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন চার ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে আইয়ুব বাঘের থাবায় আহত হয়ে পড়ে থাকলেও মনোয়ারা বেগমের অন্যান্য ছেলেরা বনেই অবস্থান করছিলেন।
তারা টাকা নিয়ে ফিরলেই আইয়ুবের জন্য কবিরাজের কাছ থেকে ওষুধ আনা হবে, জানালেন তিনি।
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আসলেও আইয়ুবরা হেরে যাচ্ছে দৈন্যতার কাছে। কখনো সময়ের কাছে।
মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, আইয়ুবকে বাঘে ধরে সকাল ১১টায়। আর সে চিকিৎসা পায় রাত সাড়ে আটটায়। ততক্ষণে তার শরীর থেকে ঝরে যায় প্রচুর রক্ত।
সেদিন নৌকার ভিতরে এত রক্ত জমে যে তা সেচে ফেলতে হয়েছিলো। পথেই ভিজে যায় দুইটি লুঙ্গি, একটি গামছা আর একটি শার্ট।
শ্যামনগরের গাবুরা গ্রামে এখন যে আইয়ুব শুয়ে আছেন তার শরীরটিকে কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। “আগে অনেক জোয়ান তাগড়া ছিলো আইউব, বলছিলেন তার প্রতিবেশী জয়নাব।
দূরে ঘোমটা দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আইয়ুবের স্ত্রীকে। ছোট্ট একটি সন্তান নিয়ে অসহায় মুখে স্বামীর অসহায়ত্বকে বরণ করে নেওয়াই যেন তার ভাগ্য!