হিমালয় অধ্যুষিত পাহাড়, অরণ্য আর প্রাচীন স্থাপত্যকলার দেশে নেপাল যাচ্ছেন ভেবে আনন্দে মাতোয়ারা ছিলেন তারা। সবার মুখাবয়েই ছিল উচ্ছ্বাস আর খুশির ঢেউ। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখতে যাওয়া সেই হতভাগারা দেশে ফিরেছেন আপনজনদের কাছে। তবে নিথর দেহে। তাদের এই ফেরা শুধু প্রিয়জনদের ব্যথিত করেনি, পড়ন্ত বিকেলের রোদ্রোজ্জ্বল দিনেও দেশবাসীর মনে গভীর কষ্টের দাগ কেটে গেছে, ছায়া ফেলেছে শোকের।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে তাদের লাশ পৌঁছলে শোকাচ্ছন্ন মানুষের চোখ ছল ছল করে ওঠে। লাশ বুঝে নেয়ার জন্য আসা আত্মীয়-স্বজনদের বুক চাপড়ে কান্না উপস্থিত সবার হৃদয় স্পর্শ করে। সৃষ্টি হয় হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। শোকাচ্ছন্ন মানুষের কষ্টের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে নীলিমা।
জানাজায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। জানাজা শেষে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তার সামরিক সচিব, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এরপর শুরু হয় স্বজনের মধ্যে লাশ হস্তান্তর। লাশ কাছে পেয়ে কারো মমতাময়ী মা, কারো বা স্ত্রী আবার আরো ভাইবোন কফিন ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কে তাদের সান্ত্বনা দেবে? সবাই শোকে মুহ্যমান। তবে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এগিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আত্মীয়-স্বজনদের শান্তনা দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে লাশ হস্তান্তর করা হয়। সেই সোমবার নেপাল গিয়েছিলেন তারা। তাদের অধিকাংশ একই বার সোমবারেই দেশে ফিরে। তবে নিথর দেহে।
দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ দেশে আনা হয়। আর তিন মরদেহ শনাক্ত করারও প্রক্রিয়া হয় নেপালে। আহত ১০ বাংলাদেশির মধ্যে দুজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়া হযেছে। একজনকে পাঠানো হয়েছি দিল্লিতে। ঢাকায় এনে চিকিৎসা চলছে ৬ জনের।
নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৩ বাংলাদেশির মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- আঁখি মনি, বেগম নুরুন্নাহার, শারমিন আক্তার, নাজিয়া আফরিন, এফএইচ প্রিয়ক, উম্মে সালমা, বিলকিস আরা, আখতারা বেগম, মো. রকিবুল হাসান, মো. হাসান ইমাম, মিনহাজ বিন নাসির, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহারা তানভীন শশী রেজা, অনিরুদ্ধ জামান, রফিক উজ জামান, পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ, খাজা সাইফুল্লাহ, ফয়সাল, সানজিদা ও নুরুজ্জামান।
সেখানে কথা হয় পাইলট আবিদ সুলতানের ছোট ভাই ডা. খুরশীদ মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আবিদ অত্যন্ত মিশুক ও সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তাকে অকালে হারিয়ে তার স্ত্রীও এখন মৃত্যুপথ যাত্রী। আমরা যা হারিয়েছি তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের মা-বাবা ও খালাসহ আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মা রাফিজা বেগম। সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। বিলাপে ভারি করে তুলেছিলেন স্টেডিয়াম।
তিনি বলেন, এই শোক রাখার জায়গা নেই। আমার ফুলের মত মেয়েকে কি করে মাটি চাপা দেব। আর যেন কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়। এই শোক সইতে পারা কি যে বেদনাদায়ক প্রকাশ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ফ্লাইটে নিহত ক্রু খাজা হোসেন মো. সাহেদের মা-শাশুড়িসহ পরিবার এসেছেন তার মরদেহ গ্রহণ করতে। তার শাশুড়ি ফৌজিয়া রহমান বলেন, মরদেহ নিতে এসেছি। পুরান ঢাকায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করার চিন্তা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমার হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা এভাবে নিথর হয়ে ফিরবে কখনও ভাবিনি। এই যন্ত্রণা প্রকাশ করা যায় না।
উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ (সোমবার) ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস-২১১ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ৬৭ যাত্রী ও চার ক্রুসহ দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বিমানটি বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। বাকিদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতলে ভর্তি করা হয়।