যেভাবে হারিয়ে গেলেন ড. জালাল আলমগীর

যেভাবে হারিয়ে গেলেন ড. জালাল আলমগীর

জালাল আলমগীরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলী রীয়াজের একটি লেখা পড়ে বোধদয় হলো- দেশের এই প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যুতে আমরা আসলেই কিছু করলাম না।

প্রচলিত একটি ধারা আছে- খুব যোগ্য, ভালো মানুষ কেউ মারা গেলে পরেই আমরা কেবল জানতে পারি তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের মৃত্যুতে শোকগাঁথা রচিত হয়। মিডিয়াগুলোতে অনেকেই লেখেন। কিন্তু জালাল আলমগীরের মৃত্যুর পর লিখলেন একমাত্র আলী রীয়াজ স্যার। স্যার লিখেছেন জালাল আলমগীর তার বন্ধু। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপকের লেখা পড়তে পড়তে স্যারকে দিয়েই জালাল আলমগীরের যোগ্যতার উচ্চতা পরিমাপ করি। তা করে আবারও ভুল করি। ঠিক যে ভুলটির কথা আলী রীয়াজ স্যার লিখেছেন তার শ্রদ্ধাঞ্জলির পাদটীকায়। বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে জালাল আলমগীরের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে পিতৃপরিচয়ের সূত্রে। তার পারিবারিক পরিচয়কে খাটো না করেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে: পিতৃ পরিচয় সূত্র না থাকলে আমরা কি জানতেই পারতাম না বাংলাদেশ বিষয়ক এই মেধাবী গবেষকের অকালমৃত্যুর খবর?’

অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশে। সে কারণে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও রয়েছে কে কার আগে রিপোর্ট ব্রেক করতে পারে। জালাল আলমগীরের মৃত্যুর খবরটিও বাংলানিউজ থেকে ব্রেক করা হয়। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু খবরটি বাংলানিউজের বার্তাকক্ষ থেকে কিভাবে রিলিজ করা হলো তা একটু শেয়ার করতে চাই।

সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের দিকে খবরটি নিউজরুমে আসে এভাবে, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ছেলে মারা গেছে। ঢাকার বনানী এলাকায় তার বাড়ি, সেখানেই সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।

মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ছেলে বলেই খবরটি বার্তাকক্ষে গুরুত্ব পায়। দ্রুত ক্রাইম সেকশনের রিপোর্টারদের জানিয়ে দেওয়া হয় প্রাথমিক তথ্য। ১০ মিনিট পরে ক্রাইম রিপোর্টার রিয়াজ রায়হানের ফোন, বনানী, গুলশানের পুলিশের কাছে এমন কোনো দুর্ঘটনার খবর নেই। তবে মহিউদ্দীন খান আলমগীরের নিকটাত্মীয়দের কেউ একজন ব্যাংককে মৃত্যুবরণ করেছেন তা পুলিশ জেনেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রিয়াজ রায়হানের আবারও ফোন থাইল্যান্ডের পাতায়া বিচে কোনো একটি দুর্ঘটনায় মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ছেলের মৃত্যু হয়েছে।

সকল দৈন্যতা স্বীকার করেই বলছি, তখনো কেউ সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারছিলো না আওয়ামী নেতা ও এক সময়ের ডাকসাইটে এই আমলার ছেলে ও দেশের অন্যতম শিক্ষাবিদ একটি পরিবারের এই সদস্যটির নাম কি? সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ জানা গেলো ড. জালাল আলমগীর মারা গেছেন যার বয়স হয়েছিলো ৪২ বছর।

এরপর শুরু হলো খবরটি নিশ্চিত করার পালা। আওয়ামী লীগ বিটের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শামীম খান ছিলেন গণভবনে দলের একটি বৈঠকের খবর নিতে। সেখান থেকেও খবরটির বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া গেলো। তার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে মহিউদ্দিন খান আলমগীরের বাসায় ফোন করলে যিনি ফোন ধরলেন তিনি নিজের পরিচয় জানাতে রাজি হলেন না। তার কথায় যেটুকু জানা গেলো তা হচ্ছে- থাইল্যান্ডে বিচে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে তার খবর তাদের এসএমএস এর মাধ্যমে জানানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানেন না। পরেও আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে এম কে আলমগীর খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। ওই ব্যক্তির কথায় যতটা আন্দাজ করা গেলো শনিবার দুপুরের দিকেই মৃত্যু হয় জালাল আলমগীরের।

চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত না হয়ে রাত ৭টা ৫০ মিনিটে প্রথম খবরটি রিলিজ হয় বাংলানিউজ অনলাইন পোর্টালে। আলী রীয়াজ স্যারের কাছে ক্ষমা চাইছি, সে সময় পর্যন্তও মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ছেলে পরিচয়েই খবরটি প্রকাশ না করে উপায় ছিলো না।

জালাল আলমগীর নামটি নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন বললেন, ‘এই নামে লেখা পড়েছি। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াগুলো ব্রাউজ করো।’ সুনির্দিষ্ট করে হাফিংটন পোস্টের কথাও বললেন তিনি। অনলাইনে চেক দিতেই বেরিয়ে এলো জালাল আলমগীর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সহযোগী অধ্যাপক। দ্রুত সেই পরিচয় তুলে ধরে খবর আপডেট করা হলো। এরপর একটি ছবির সন্ধানেও কেটে গেলো আরও কিছুটা সময়। যে কারণে হাফিংটন পোস্টে আর খোঁজ করা হলো না। ভুলটি হয়ে গেলো সেখানেই।

কিছুক্ষণের মধ্যে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট আনোয়ারুল করিম জানালেন ব্যাংককে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে তিনি জানিয়েছেন দুর্ঘটনার কথা তারা জেনেছেন তবে তখনো তারা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন নি। কাজী ইমতিয়াজই জানালেন দুর্ঘটনাটি পাতায়া বিচে নয় ঘটেছে ফুকেট বিচে। আবার সচল হলো নিউজরুম। অনলাইনে ভুল তথ্য শুধরে দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাতায়াকে ফুকেট করে দেওয়া হলো। কিন্তু মৃত্যুর খবর তখনো নিশ্চিত নয়। এর মিনিট পাঁচেক পরে আনোয়ারুল করিম জানতে পারলেন ফুকেট বিচে পানিতে ডুবেই তার মৃত্যু হয়েছে। নিশ্চিত করেছেন দূতাবাসেরই একজন কর্মকর্তা।

ফুকেট থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো চেক করলে বিস্তারিত জানা যেতে পারে এডিটর ইন চিফের এমন একটি উপদেশও নির্বোধের মতো এড়িয়ে গেলাম। বরং নতুন তথ্য মহিউদ্দিন খান আলমগীর তার ছেলের লাশ আনতে ব্যাংকক যাচ্ছেন, তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, নেতারা আসছেন সমবেদনা জানাতে, ব্যাংকক দূতাবাস সক্রিয় হয়েছে। মরদেহ কখন আনা হবে, কিভাবে আসবে এসব ইস্যু সামনে চলে আসে আর তাতে ব্যস্ত থাকতে হয়।

নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্য করতে সকাল থেকে ব্রাউজ করি অনলাইন পত্রিকাগুলো যাতে জালাল আলমগীরের কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইনডিয়াস ওপেন ইকোনমি পলিসি: গ্লোবালইজম, রাইভেলরি, কনটিনিউটি নামে তার লেখা বই একটি রেফারেন্স বুক হিসেবে উন্নত বিশ্বেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বায়ন এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ওপর তার প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধানী ও গভীর আলোচনা রয়েছে এই বইয়ে।

ড. আলী রিয়াজ বলেছেন, ‘যারাই সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন ও রূপান্তর নিয়ে ভাবেন, তারাই এই বই পড়ে লাভবান হবেন।’

২০০০ সালে ব্রাউন বিশ্ববিদালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি নেন জালাল আলমগীর। এরপর কাজ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট, ভারতের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ এর সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন তিনি। ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনিসিয়েটিভের ফেলো।

ড. আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘প্রচারবিমুখ এই তরুণ গবেষক খুব কম সময়ের ভেতরে নিজেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক একজন গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।’

আর সেই প্রচারবিমুখতার প্রভাবেই হয়তো অত্যন্ত মেধাবী আন্তর্জাতিক মানের গবেষক ড. জালাল আলমগীর শ্রেফ ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ছেলে এই পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে থাকে বাংলানিউজের পাতায়। আমরা দুঃখিত।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর