ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এক সময়কার জমিদারবাড়ি ‘ব্রজনিকেতন’ দখলদারদের কবলে পড়ে এখন জজবাড়ি। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জে কারুকার্য খচিত অনিন্দ্য সুন্দর প্রাসাদসহ বিশাল এ জমিদারবাড়ি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আশফাক পরিবারের লোকজন দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৪ একর ৫৭ শতক জমির উপর নির্মিত ‘ব্রজনিকেতন’ নামের এ বাড়িটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এর বর্তমান নাম ‘জজবাড়ি’।
উপজেলার চেয়ারম্যান আবু আশফাকের ভাই জজবাড়ির জজ আবুল হোসেন মামুন ফেনী জেলা যুগ্ম জজ হিসেবে কর্মরত।
চলতি বাজারে কোটি কোটি টাকা মূল্যের এ প্রাসাদটি ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে নির্মাণ করেছেন জমিদার সুদর্শন রায়। জমিদারের বংশধরদের মধ্যে সর্বশেষ ওয়ারিশ ছিলেন মানিক রায়ের ছেলে মধুসুদন রায়, মোদক রায়ের ছেলে শ্যামলাল রায়, হরে কৃষ্ণের ছেলে কানাইলাল সাহা ও মোহন সাহা।
ভূমি অফিসের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির পর জমিদারবাড়ির লোকজন ভারতে চলে যায়। সিএস রেকর্ডীয় মালিক ভূমি অধিকারী একজন জমিদার হওয়ায় এবং তার বংশের কোনো মালিক অবশিষ্ট না থাকায় নিয়মানুযায়ী বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা ভিপি সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, জমিদারের ওয়ারিশরা চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন বাড়িটি বেদখল ছিল। আনুমানিক ২০-২৫ বছর আগে হঠাৎ করে বাড়িটি বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আশফাকের পরিবারের লোকজনদ দখল করে নেন।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, জমিদারবাড়িটি মৃত এম. গোলজার হোসেনের নামে এবং এটি দেখভাল করার দায়িত্ব (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তার) চেয়ারম্যানের ভাই আবুল কালাম খন্দকারকে দেওয়া হয়েছে এমন দাবিতে চেয়ারম্যান পরিবারের লোকজন বাড়িটি দখল করে রেখেছে।
এদিকে সম্পত্তিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দাবি করছে সরকার। এ নিয়ে সরকার পক্ষের সঙ্গে সম্পত্তির মালিকানা দাবিকারীদের মামলা চলছে।
ভূমি অফিসের ভাষ্যমতে, ভিপি লিজ কেইস নং ১২৮২/৬৭ এবং ৪৭/৮৫ অনুযায়ী কলাকোপা মৌজার ১৮.৫১৫০ একর এবং হযরতপুর মৌজার ১.৫৫ একর সম্পত্তি আনসার একাডেমি কলাকোপার নিকট লিজ দেওয়া হয়। লিজকৃত মোট ২০.০৬৫০ একর জমির মধ্যে `ব্রজনিকেতন`ও অর্ন্তভূক্ত।
এ নিয়ে ভূমি অফিসের বক্তব্য, আনসার একাডেমির কাছে মোট লিজকৃত জমির ৫ একর ৫৭ শতকের ব্রজনিকেতন বাড়ির অংশটুকু জাল রেকর্ডপত্র তৈরির মাধ্যমে বে-আইনিভাবে দখল করে রেখেছে উপজেলা চেয়ারম্যান পরিবারের লোকজন। এ পরিবারের লোকজন জাল রেকর্ড দেখিয়ে দেওয়ানী মামলা ১০৩/৯০, ১৮৭/৯২ করে আদালত থেকে একতরফা রায়ে নিয়ে তাদের দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়।
অবশ্য পরবর্তীতে সরকার পক্ষ দেওয়ানী আপিল ২৫৩/৯৩ ও ২৫৪/৯৩ দায়ের করে দো-তরফা সূত্রে রায় ও ডিক্রি পায়। যার আলোকে জাল দলিল বাতিল করা হয়।
কিন্তু দলিল বাতিল করা এ রায়ের বিরুদ্ধে জজবাড়ির লোকজন হাইকোর্টে এফ.এ ৯৪/০৭ ও এফ.এ ৯৫/০৭ মামলা দায়ের করে। যার কারণে আদালত সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে।
জমিদার বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি হওয়ায় এলাকাবাসীর দাবি জমিদার বাড়িটিকে পর্যটনকেন্দ্র করার। নাম না প্রকাশ করার শর্তে স্থানীয় একজন স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, “এ বাড়িটি ছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি পুরনো স্থাপত্য রয়েছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করে পর্যটন এলাকা করা যেতে পারে। নবাবগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান আবু আশফাক ও ওই বাড়ির লোকদের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে বিষয়টি নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চাচ্ছে না।“
এদিকে এখানকার আরেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি খেলারাম দাতার বাড়ি। কলাকোপা পুকুরপাড় পাড়ার এ বাড়িটি ভেঙে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কেউ এর দেখাশুনা করছে না। অথচ একটু যত্ন নিয়ে এটিকে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত করা যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, “খেলারাম দাতার বাড়িটি প্রকাশ্যে কারো দখলে নেই। কাগজে কলমে কেউ দখল করে নিয়েছে কিনা জানি না। তবে বাড়িটির পুকুরের দেখাশুনা করছে নবাবগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান আবু আশফাকের ভাই আবুল কালাম খন্দকার ও মাসুদ।“
ব্রজনিকেতন তথা জজবাড়ি নিয়ে নবাবগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘“ম্পত্তিটি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। বাড়িটি উদ্ধারের জন্য ভূমি অফিস চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাড়িটির ঐতিহাসিক মূল্য থাকায় এটি জাদুঘর হওয়ার মতো একটা জায়গা।“
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জজ আবুল হোসেন মামুনের সঙ্গে কথা বললে তিনি নম্বরটি তার নয় বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আশফাকের মোবাইল নম্বরটিতে যোগাযোগ করে বন্ধ পাওয়া যায়।