রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভিয়েতনামের সহযোগিতা কামনা করেছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার দুপুরে তাঁর কার্যালয়ে তাঁর এবং ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংয়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দু’দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
‘আমরা এই অঞ্চলের দেশগুলোর শান্তি ও স্থিতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আমি ভিয়েতনামের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি,’ বৈঠকের পর অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং সমস্যার একটি সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রতি তাঁর সহযোগিতার বিষয়ে সমর্থন প্রকাশ করেছেন, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে বলেন, তাঁরা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সকল বিষয়ে বৈঠকে সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছেন এবং পারস্পারিক সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ককে আরো পাকাপোক্ত করার পাশাপাশি তাদের আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় ফরেন অফিস কনসালটেশন এবং ব্যবসা সংক্রান্ত যৌথ কমিটির দ্বিতীয় বেঠক এ বছর অনুষ্ঠানের বিষয়ে উভয়ে বৈঠকে একমত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘মৎস এবং প্রাণিসম্পদ, যন্ত্রাংশ তৈরী এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়ে দু’দশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় আমরা আরো খুশী হয়েছি, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের আসিয়ান ভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশ করে ‘মেকং-গঙ্গা’ সহযোগিতা ফোরামে যোগদানে আগ্রহের কথাও জানান।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে এবং ‘মেকং-গঙ্গা’ ফোরামে যোগদানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে ভিয়েতনামের সহযোগিতা কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট কুয়াংকে জানিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও ফ্লাইটের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাসহ সমুদ্র ও মহাসাগরের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিয়ম-ভিত্তিক আদেশ বজায় রাখায় জন্য বিশ্বাস করে।
তিনি বলেন, আমরা ১৯৮২ সালের কনভেনশন মতে সকল সমুদ্র আইন (ইউএনক্লজ) অনুযায়ী আঞ্চলিক ও সমুদ্রবিরোধসহ সকল আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আস্থাশীল।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংকে বাংলাদেশ সফরে আসার সময় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল সঙ্গে নিয়ে আসায় ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,তারাই (দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়) দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির উপায় ও পদ্ধতি খুঁজে বের করতে সমর্থ হবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম উভয়ের উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করছি দুই দেশের অর্থনীতির জন্য সম্ভবনা খুঁজে বের করার।’
বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের নিকট প্রতিবেশী উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম একইরকম শান্তি ও প্রগতির প্রত্যাশী। উভয় দেশের জনগণও একই ধরনের রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের অংশীদার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভিয়েতনামের মহান নেতা হোচি মিন তাঁদের দেশের জনগণের স্বাধীনতার জন্যই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
‘অসম শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামীদের সংগ্রাম বাংলাদেশকে তাঁর মুক্তির সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছিল। ছাত্রনেতা হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ষাটের দশকের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে আমিও অংশ নিয়েছিলাম, আমি এখনও সেগুলো মনে করতে পারি, সেগুলো আমার স্মৃতিতে আজও সমুজ্জ্বল, ’বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশ সফরের জন্য প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংকে ধন্যবাদ জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাঁর এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক দূর নিয়ে যাওয়ায় এবং নতুন উচ্চতায় আসীন করতে ভূমিকা রাখবে।
বিবৃতিতে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে খোলামেলা এবং অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আলোচনায় আমরা দু’দেশের বিদ্যমান ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করি এবং দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উৎসাহব্যঞ্জক অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করি।’
প্রেসিডেন্ট কুয়াং বলেন, তারা ৪৫ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন এবং ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, যুব জনসংখ্যা এবং বিশাল বাজারের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে যে, তারা দেশের জনগণ এবং নেতৃবৃন্দের আকাঙ্খা ও স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্র্ণ সাফল্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
রাজনৈতক ও কূটনৈতিক বিষয়ে তিনি বলেন, উভয় দেশ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফর বিনিময়ের পাশাপাশি বহুজাতিক সম্মেলনের সাইড লাইনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের সহযোগিতায় উচ্চপর্যায়ের চুক্তি বাস্তবায়ন এবং তথ্য জোরদার ও উন্নয়নের জন্য যৌথ বাণিজ্য উপ-কমিটি এবং রাজনৈতিক পরামর্শসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করতে সম্মত হয়েছি।’
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে, তারা একে অপরের প্রয়োজন এবং সামর্থের ভিত্তিতে সহযোগিতা করতে সম্মত হন, পাশাপাশি প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক মনোযোগ দেওয়া এবং শান্তি-রক্ষা অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করায় সম্মত হন।
উভয় পক্ষই সামরিক ক্যাডেটদের ভাষা শিক্ষণ এবং বিশেষায়িত কর্মসূচির জন্য গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, বলেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে কুয়াং বলেন, উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উভয় দেশ ও অঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপরাধ ও সন্ত্রাসের তথ্যাদি বিনিময় করতে সম্মত হয়েছে।
অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বিষয়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, উভয় পক্ষই ব্যবসায়িক কর্মকান্ড সম্প্রসারণ ও একে অপরের সম্ভবনা কাজে লাগানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করবে এবং সম্ভাবনা ও সুবিধা বিবেচনা করে সম্ভাবনাময় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ জোরদারের প্রস্তাব করবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, ঢাকা ও হ্যানয় পরস্পরকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সুবিধা দেবে, যেমনটি প্রতিটি দেশের সুবিধা রয়েছে এবং অন্যান্য অঞ্চলের আরো সম্ভাবনাগুলোর দিকে নজর রাখবে এবং ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য তথ্য ও বাণিজ্য সংযোগ বাড়ানোর সুবিধা প্রদান করবে।
কৃষি, মৎস এবং প্রাণিসম্পদ বিষয়ে সহযোগিতার বিষয়ে কুয়াং বলেন, দুই দেশেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একত্রে কাজ করার এবং যৌথ মালিকানাধীন প্রকল্প স্থাপন এবং উৎপাদন পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, প্রতিটি দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা উৎপাদন, চাষ এবং সংরক্ষণে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার করে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করে থাকেন এবং তৃতীয় কোন দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতাগুলো থেকেও এগুলোকে রক্ষা করেন।
প্রশিক্ষণ, সংস্কৃতি এবং পর্যটন বিষয়ে তিনি বলেন, হ্যানয় বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সেখানে প্রশিক্ষণ এবং জনপ্রশাসন,অর্থনৈতিক উন্নয়ন,কৃষি, অ্যাকুয়া কালচার ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে অভিজ্ঞতার বিনিময়কে অব্যাহত রাখাকে স্বাগত জানায়।
কুয়াং বলেন, ভিয়েতনাম সে দেশের ন্যাশনাল একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং বাংলাদেশের লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) মধ্যে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পারস্পরিক বিনিময় সংক্রান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করে।
দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৯৮২ সালের জাতিসংঘ ক্লজের সদস্য হিসেবে, উভয় পক্ষ অবাধ নৌচলাচল এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সকল আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করার জন্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। যার মধ্যে সীমানা বিরোধ এবং সমুদ্র সংক্রান্ত বিরোধও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কুয়াং বলেন, বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪৫ বছর অতিবাহিত হবার পর তাঁরা আজকের সম্পাদিত চুক্তিগুলোকে দু’দেশের সম্পর্কের যথাযথ উন্নয়নে এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে কাজে লাগানোর বিষয়েও বৈঠকে একমত হয়েছেন।
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, তারা পারস্পরিক উন্নযনের স্বার্থে উভয় দেশের মধ্যে অভিজ্ঞতা এবং সহযোগিতার বিনিময় অব্যাহত রাখতেও একমত হয়েছেন।
তিনি তাঁর এবং ভিয়েতনামের জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্য এবং জাতীয় উন্নয়নও প্রত্যাশা করেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।