প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে নৌকার বিজয় হবে এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ‘ইনশাল্লাহ নৌকার জয় হবে, উন্œয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকেলে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে খুলনা জেলা এবং মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচনে আমি আপনাদের কাছে চাই- গত নির্বাচনে যেমন নৌকায় ভোট দিয়েছেন উন্নয়ন হয়েছে। এই নির্বাচনে আপনারা যদি উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চান তাহলে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে দুই হাত তুলে নৌকায় ভোটদানের ওয়াদা চাইলে জনগণ দুই হাত তুলে সমস্বরে চিৎকার করে ভোট প্রদানের অঙ্গীকার করেন।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশিদ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতা করেন- দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং ডা. দীপু মনি, সাংগঠসিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এমপি, শেখ হেলাল এমপি, বিজেএমই’র সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদীসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবো। আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশে আমরা দারিদ্র্যের হার কমিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই খুলনা শহর এবং খুলনা বিভাগের আমাদের প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা নিজেরা একদিনের বেতন দিয়ে ফান্ড তৈরি করেছে, সেখান থেকে এই খুলনা শহর ও বিভাগকে ভিক্ষুকমুক্ত করা হয়েছে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি তাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। কারণ বাংলাদেশের মানুষ ভিক্ষা করে চলবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করবে। আমরা সেটাই দেখতে চাই, সেটাই করতে চাই। দেশের আরো উন্নয়নের জন্য তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশ হবে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ।
তিনি বলেন, আমি আপনাদের কাছে শুধু একটা কথাই বলবো। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছি। এই বাংলাদেশে কোন রাজাকার-আল বদর, যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই হবে না। তাদের বিচার আমরা বাংলার মাটিতে করেছি, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারও আমরা বাংলার মাটিতে করেছি। অপরাধী যেই হোক তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে খালেদা জিয়া দুর্নীতি করেছেন। কোর্ট রায় দিয়েছে। সেই রায়ে সে কারাগারে। এখানে আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই, আমাদের কিছু করার নেই। দুর্নীতি করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, বাংলাদেশকে উন্নত করতে চাই, আমরা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী করতে চাই। কাজেই আপনারা যখনই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন, মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছেন এবং আপনারা দেশের উন্নয়ন পেয়েছেন।
সার্কিট হাউস মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় অংশগহণের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী সমাবেশস্থলের পাশের বেদী থেকে ৯৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে প্রকল্পের সংখ্যা একশ’ বলে উল্লেখ করেন।
খুলনার কর্মসূচিতে অংশ নিতে শনিবার বেলা পৌনে ১১টায় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে তিতুমীর নৌ-ঘাঁটির ভিভিআইপি হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। পরে তিনি ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ’র (আইইবি) খুলনা কেন্দ্রে আইইবি’র ৫৮তম কনভেনশনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটি খুলনায় প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফর। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি খুলনা শিপইয়ার্ডে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রাক-নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে সিলেট, বরিশাল এবং রাজশাহীর পরে রুপসা পাড়ের খুলনায় এলেন।
জনসভাকে কেন্দ্র করে খুলনা শহর পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে মানুষ জনসভাস্থলের দিকে ছুঁটেছেন। খুলনার সব পথ এসে যেন মিশেছে সার্কিট হাউজ মাঠে। দুপুরের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় জনসভাস্থল। মহানগরী ছাড়াও বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যোগ দেন জনসভায়। নেতা-কর্মীদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে জনসভার আশপাশ।
শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা জানেন নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে কত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। তারা নিজের অফিসে বসে থেকে ঘোষণা দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত না করে তিনি (খালেদা জিয়া) না-কি ঘরে ফিরবেন না। প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি অফিসে বসেছিলেন। উনি অফিসে বসে বিরিয়ানি খান আর মানুষ পোড়ানোর হুকুম দেন। প্রায় ৫০০ মানুষকে ওই খালেদা জিয়া আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। এতে আহত হয়েছে আরো প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকার কোনো পথ নেই, সব পথ বন্ধ। তারা ধ্বংস করতে জানে, সৃষ্টি করতে জানে না। মানুষকে বাঁচাতে জানে না, হত্যা করতে পারে।
সরকার প্রধান বলেন, আমরা উন্নয়নে বিশ্বাস করি আর বিএনপি কি করে? বিএনপির কাজ ছিল সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সৃষ্টি। মানুষ হত্যা করা, আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারা। ওরা যখনই ক্ষমতায় ছিলো, সেই জিয়ার আমল থেকে শুরু করে প্রতিবার মানুষ হত্যা ছাড়া আর কিছুই করেনি। তিনি বলেন, বিএনপির সময় এ খুলনা ছিলো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য। প্রতিদিন খুন, প্রতি মুহূর্তে মায়ের কোল খালি হতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কঠোর হস্তে জঙ্গি দমন করা হয়েছে। খুলনা এখন শান্তির নগরী।
তিনি মঞ্জুরুল ইমাম, হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহাসহ বিএনপি-জামায়াত এবং সন্ত্রাসীদের নির্মমতার শিকার হয়ে খুলনায় নিহতদের পরিসংখ্যানও জনসভায় তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পুনরুল্লেখ করে বলেন, ‘এখানে যেনো আর কোনো ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে জন্যে সকলের সহযোগিতা কামনা করি।’ তিনি অভিভাবক-শিক্ষকদের তাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, কি করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকে কি-না তার প্রতি লক্ষ্য রাখারও আহবান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে এসেছিলাম, ওয়াদা করেছিলাম খুলনার সার্বিক উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়ার। আজকে আপনারা দেখেছেন, আমি ১০০টি প্রকল্প যার মধ্যে ৪৮টি উদ্বোধন ও ৫২ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়েছি। যে সমস্ত বন্ধ কল-কারখানা ছিলো সেগুলো চালু করেছি। যাতে করে উৎপাদন বাড়ে। ওই জুট মিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কল-কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। শুধু তাই না, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাস্তা-ঘাট, পুল-ব্রিজ নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করেছি। খালেদা জিয়া খুলনায় বক্তৃতা দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে সব কল-কারখানা চালু করবে। কিন্তু সব বন্ধ করেছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বন্ধ কল-কারখানা, মংলাবন্দর চালু, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যা ওয়াদা দিয়েছিলাম এর বাইরেও যে সমস্ত কাজ জনগণের জন্য কল্যাণকর সেগুলো আমরা করেছি। আমাদের লক্ষ্য উন্নয়ন। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, আপনারা জানেন ওই মংলা বন্দর বন্ধ করে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, মংলা বন্দর পর্যন্ত যেনো রেল লাইন যায়, পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে যশোর-বাগেরহাট হয়ে মংলাবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন যাবে সে প্রকল্প বাস্তবায়নে তাঁর সরকার কাজ শুরু করেছে।
খুলনাবাসীর উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, একটা সুখবর দিতে চাই। ভোলায় অনেক গ্যাস পাওয়া গেছে। আমরা পরিকল্পনা নিচ্ছি সেই গ্যাস পাইপলাইনে করে বরিশাল এবং খুলনায় যাতে আসে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেউ কুঁড়েঘরে থাকবে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রত্যেকটা মানুষের ঘর-বাড়ি তৈরি করে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। আশ্রায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ মানুষকে ঘর করে দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা গুচ্ছগ্রাম শুরু করেছিলেন। তাঁর সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ ঘরবাড়ি করে দিয়েছে। এ দেশে কেউ কুঁড়েঘরে থাকবে না, নিদেন পক্ষে একটা টিনের ঘর হলেও সরকার করে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের যুব সমাজকে লেখাপড়া শেখাতে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। কর্মসংস্থান ব্যাংক করেছি। বিনা জামানতে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে যেকোনো যুবক। সেটা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, সঙ্গে আরো লোকদের কাজ দিতে পারবে সে ব্যবস্থা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বিদেশে যাবে ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি আর বিক্রি করতে হবে না। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিদেশে যেতে পারবে সে ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, দেশের কৃষক যেন ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় তার ব্যবস্থা করেছি। সারের দাম বার বার কমিয়েছি। কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সার, বীজের পাশাপাশি কৃষক ১০ টাকায় যেন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি। সে সঙ্গে দুই কোটি কৃষককে কৃষি উপকরণ কার্ড দিচ্ছি।
দেশে এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে এবং যেসব স্থানে বিদুতের সঞ্চালন লাইন নেই সেখানে সোলার সিস্টেমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে আমরা আলো জ্বালতে চাই। ইনশাল্লাহ ২০২১ সালের মধ্যে আমরা সব ঘরে আলো জ্বালবো।
প্রধানমন্ত্রী বছরের প্রথম দিন দেশব্যাপী মাধ্যামিক পর্যায়ে তাঁর সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের কর্মসূচির উল্লেখ করে বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে। তাদের বই কিনতে হয় না। বই কেনার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বই কিনে দিচ্ছি। ১ জানুয়ারি বই উৎসব হয়। আমরা ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ১৬২ খানা বই বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছি। এ জন্য অভিভাবকদের একটা টাকাও খরচ করতে হয় না। সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। সে ধারাতেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।