কর্মী অসন্তুষ্টি বাড়ছে, ঝুঁকি বাড়ছে আমানতের অনভিজ্ঞ এমডি দিয়ে চলছে এবি ব্যাংক!

কর্মী অসন্তুষ্টি বাড়ছে, ঝুঁকি বাড়ছে আমানতের অনভিজ্ঞ এমডি দিয়ে চলছে এবি ব্যাংক!

বেসরকারি ব্যাংকিং খাতে দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবি ব্যাংক লিমিটেডে কর্মী অসন্তুষ্টি ক্রমেই বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তার পাশাপাশি ব্যাংকে আমানতের ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে বাড়ছে অসন্তুষ্টি ও আশঙ্কা।

বিতর্কিত ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত হিসেব চিহ্নিত ব্যাংকার ফজলুর রহমানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে ব্যাংকটি পরিচালনার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন সদস্য এই এমডি’র পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় কয়েক দফা বিতর্ক সৃষ্টির পরেও তিনি বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

ফলে ব্যাংকের ভিতরে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এ কারণে ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে পুরনো এই বেসরকারি ব্যাংকটি। ঝুঁকিতে পড়ছেন এর সাধারণ আমানতকারীরা। সার্বিকভাবে যা অর্থনীতির জন্য তথা ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

এ বিষয়ে গত এপ্রিল মাসে বাংলানিউজে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। এরপর প্রায় এক মাস সময় পার হলেও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে ব্যাংকটির কর্মীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আরও বাড়ছে।

সূত্র জানায়, বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে এমডি হিসিবে নিয়োগ দেওয়ার ফলে ব্যাংকের উর্ধ্বতন অনেক কর্মকতা অসন্তুষ্ট। তারা প্রকাশ্য কিছু না বলতে পারলেও ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ এবং হতাশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা বাংলানিউজকে জানান, স্বনামধন্য এবং দেশের সবচেয়ে পুরনো এই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে এমন অনিয়ম ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ সংবাদ। আমানতকারীরা আমানত নিয়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন। ইতোমধ্যে ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে এর প্রতিফলন প্রকাশ পাচ্ছে বলেও জানান তারা।

এ বছর এপ্রিলের ৩ তারিখে ফজলুর রহমানকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চার এপ্রিল থেকে তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এবি ব্যাংকের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তার দায়িত্ব পালন শুরুর কথা জানানো হয়। এর আগে তিনি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সূত্র জানায়, দায়িত্ব পালন শুরুর পর থেকে ফজলুর রহমান ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারীর স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর রয়েছেন। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিতি থাকায় ব্যাংকে তার নিজস্ব ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সেবায় অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী, কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে হলে তার কমপক্ষে ১৫ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।  সে শর্তও পূর্ণ হয়নি ফজলুর রহমানের ক্ষেত্রে। ব্যাংকিং খাতে তার অভিজ্ঞতা সাড়ে ১১ বছরের বলে জানা গেছে।

এছাড়া শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে শেয়ারবাজারে শীর্ষ খেলোয়াড়দের যে তালিকা দেওয়া হয়েছিলো সেখানে ফজলুর রহমানের নাম রয়েছে।

এত বড় কেলেঙ্কারীর পর তদন্ত থেকে অভিযুক্ত একজনকে দেশের সবচেয়ে পুরোনো বেসরকারি ব্যাংকটির এমডি করায় সমালোচনার ঝড় উঠলেও তাকে থোরাই পাত্তা দিচ্ছেন ফজলুর রহমান।

সূত্র জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ফজলুর রহমানকে এমডি হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানে ছিলো। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশও তাকে এমডি করার বিষয়ে ™ি^মত পোষণ করে। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির পক্ষ থেকে গত ২৯ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগেই গত ১৯ জানুয়ারি থেকেই  ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছিলেন ফজলুর রহমান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক এমডি নিয়োগে বিধি লংঘনের বিষয়টি অনেকটা স্বীকার করে নিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, আমি এমডি নিয়োগে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এমনটি মানতে রাজি নই। কেন এমন হতে হবে। দেখতে হবে তিনি চালাতে পারেন কিনা।

খারাপ চালালে তো তাকে বাদ দেওয়া হবে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতো তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে না।

নতুন এমডির ব্যাংকিং পেশা ১৫ বছর হয়নি এমন তথ্য সঠিক নয় বলেও দাবি করেন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক। বাংলাদেশ ব্যাংক আইন ও বিধান মেনেই এই নিয়োগ চূড়ান্ত করেছে। এখানে আইনের কোন ব্যতয় হয়নি, দাবি ওয়াহিদুলের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে আবেদন জমা দেওয়া হয় সেখানে ফজলুর রহমানের অভিজ্ঞতা ১৫ বছর দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এখাতে তার সাড়ে ১১ বছরের অভিজ্ঞতা।

এই সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে এবি ব্যাংকেই কাজ করেছেন নয় বছর সাত মাস আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান জিএসপি ফাইন্যান্সে কর্মরত ছিলেন এক বছর ১০ মাস।

মাঝে ৫ বছর তার কেটেছে কন্টিনেন্টাল হাসপাতালে। সেখানে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০২ সালের আগষ্ট পর্যন্ত কর্মরত থাকেন তিনি।

এবি ব্যাংকে ডিএমডি পদে থাকাকালে ফজলুর রহমান বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। শেয়ার বাজারের ধসের জন্য যে কয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে এবি ব্যাংক একটি।

শেয়ারবাজার উত্থান পতনে ফজলুর রহমানের বড় ধরনের ভূমিকা ছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। সেসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা উপেক্ষা করে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ায়। তাতে ব্যাংকটির সাময়িক মুনাফা বাড়ে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই কাজের পুরস্কার হিসেবেই নতুন এমডি’র দায়িত্ব পেয়েছেন ফজলুর রহমান।

তবে ওই মুনাফা আর ধরে রাখতে পারছে না এবি ব্যাংক। গত বছর আশঙ্কাজনক হারে মুনাফা কমেছে ব্যাংকটির। ২০১০ সালে যেখানে ব্যাংকটির ৩৯৯ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়েছিলো ২০১১ সালে তা কমে ১৩৩ কোটি টাকায় নেমে আসে।

সার্বিকভাবে ব্যাংকটির মুনাফা কমে আসায় ঝুঁকি বাড়ছে আমানতকারীদের। আর এ কারণেই তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ ও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত হিসেবে প্রমাণিত একজন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকায় আমানতকারীদের মধ্যে আশঙ্কা আরও জোরদার হচ্ছে।

অর্থ বাণিজ্য