সার্ধশত পেরিয়ে বাঙালির দিবাকর

সার্ধশত পেরিয়ে বাঙালির দিবাকর

আজ (৮ মে) পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী ও ১৫১তম জন্মবার্ষিকী। দেড়শত বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল তার জন্মদিনের। তবুও বাঙালির মানসে এখনো তিনি দিবাকরের মতো সমানভাবে সমুজ্জল, তার কিরণ এতোটুকু ম্লান হয়নি।

প্রতি বছরই এদিনটি আসে, চলেও যায়; কিন্তু আমাদের নতুন করে দিয়ে যায় আত্মপরিচয়ের তাগিদ। আত্মশক্তির উদ্বোধনের আহ্বান, মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসার বারতা। এদিনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের শুভদিন, জাতি হিসেবে আমাদের শুভ সংকল্পগুলো নবায়নেরও দিন।

রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বিরাট প্রেরণার উৎস হয়ে ছিল। বিশ্বে খুব কম কবিই এরকমভাবে কোনো দেশের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। বাঙালি জাতির অহংকার তিনি।
বহুমাত্রিক পরিচয় তার। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার,  প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও একজন দার্শনিক। শুধু তা-ই নয়, তিনি মানবতাবাদের এক অবিস্মরণীয় ধারক। বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসে তাদের আত্মপ্রকাশের সহযাত্রী।

কবিগুরুর সার্ধশত তম জন্মবার্ষিকীর বছরব্যাপী মহাযজ্ঞের সমাপ্তি আর ১৫১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ নগরের অনেক মিলনায়তনে বাজবে তার গান। সেখান থেকে নৃত্যের তালে আর নূপুরের নিক্কন ধ্বনীতে ছড়িয়ে পড়বে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। নাচে, গানে আলোচনায় বাঙালি জাতি আজ স্মরণ করবে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ
বাঙালির চিন্তায়, চেতনায়, মননে- এক কথায় সমগ্র সত্তাজুড়েই রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে বিরাজমান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে এবং বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কবিগুরুর ছদ্মনাম ভানুসিংহ ঠাকুর।

বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি। গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’তে তার ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা।

১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার শশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহিতে।

১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।

১৯০২ সালে তার স্ত্রী মৃণালিনী মারা যান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কবি। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেই উপাধি ত্যাগ করেন।

১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।  দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।

তার সম্পাদনায় ভারতী, সাধনা, বঙ্গদর্শন প্রভৃতি পত্রিকা বের হয়। ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘মানসী’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘সোনার তরী’ ‘বলাকা’, ‘গীতবিতান’, ‘নৈবেদ্য’, ‘গীতাঞ্জলি’ তার কাব্য। ‘শেষের কবিতা’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’, ‘চতুরঙ্গ’ তার রচিত উপন্যাস। ‘ছিন্নপত্র’ তার অবিস্মরণীয় পত্রসাহিত্য।

বাহান্ন বছর বয়সে ১৯১৩ সালে তিনি তার গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য বিশ্বসাহিত্যের সবচে সম্মানজনক পদক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে তিনি বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন ‘শান্তি নিকেতন’।

নওগাঁর পতিসরে নিজের জমিদারির গরিব প্রজাদের নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে তিনিই প্রথম গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও পাবনার শাহজাদপুরে তার জমিদারিতে প্রজাদের কল্যাণের স্বার্থে আরও অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

৮০ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কলকাতার, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য- ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা।

বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবিগুরুর ১৫১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারত নানা আয়োজনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন করবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার জয়ের শতবর্ষও পালন করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ