আসন্ন বাজেটে প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে বলে অভিমত দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এছাড়া ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের গলার ফাঁস হয়েছে বলে সিপিডি মনে করছে।
সিপিডির মতে, এবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে তার প্রভাব গিয়ে পড়বে আগামী নির্বাচনে। অনেকেই একে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করবেন। তারা কালো টাকাকে অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে দেখিয়ে কর দিয়ে বৈধ করে নেবেন। পরে সেই টাকাই নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে ব্যবহার করবেন।
আবার নতুন ব্যাংকের অনুমোদন যারা পেয়েছেন, সেগুলোর উদ্যোক্তারাও এ সুযোগ ব্যবহার করতে চাইবেন। এজন্য সর্তক থাকতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এমনটাই মনে করে সিপিডি।
সোমবার সিপিডির পক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিমত দিয়েছেন এর সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আসন্ন ২০১২-১৩ অর্থ বছরের বাজেটের জন্য সংস্থাটির সুপারিশ-প্রস্তাব তুলে ধরতে সিপিডি কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সিপিডির পক্ষে এর গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. ফাহমিদা খাতুন বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানসহ এর গবেষণা বিভাগের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, “আমরা সব সময় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিরোধিতা করি। এটা (এই সাদা করাটা) অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এতে করে প্রকৃত ও সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে অনাচারকেই উৎসাহিত করা হয়। এছাড়া এরকম কোনো নজির নেই, এমন সুযোগ দেওয়ার ফলে কার্যকর সুফল পাওয়া গেছে। তাই তথাকথিত কালো টাকার মালিকদের এমন সুযোগ দেওয়া মোটেও ঠিক হবে না।“
তিনি আরো বলেন, “ উল্লেখিত কারণগুলোর বাইরে এবার আরো দুটো বিশেষ কারণ আছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে একটি গোষ্ঠী সেটির সুযোগ হিসেবে নিতে চাইবে। এটা অপ্রত্যাশিত হবে।“
দেবপ্রিয় এ সময় সর্তক করে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এগুলোর উদ্যোক্তাদের অনেকে চাইবেন, এ সুযোগ ব্যবহার করতে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে।“
তবে তারপরও নিয়মিত করের পাশাপাশি শাস্তিমূলক কর আরোপ করে এ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলে মত দেন তিনি। কিন্তু কতো বছর এমন সুযোগ অব্যাহত থাকবে–এ ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান হওয়া উচিত। কারণ প্রতি বছরই বলা হয়, “এবারই শেষ সুযোগ।“
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির এই সম্মানিত ফেলো জানান, “বিগত বছরগুলোতে আমাদের প্রবৃদ্ধির যে উচ্চ ধারা ছিলো তা শ্লথ হয়ে এসেছে। কারণ, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে। প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে চাইলে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারের ঋণ নেওয়া কমাতে হবে।“
একই সঙ্গে ঋণের সুদের হার কমানো, বৈদেশিক ঋণ বাড়ানো এবং বৈদেশিক সাহায্য ছাড় বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তবে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। যা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি। এছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচার জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
“তবে বাজেট যা-ই হোক, যেমনই হোক তার বাস্তবায়নটাও চ্যালেঞ্জের“ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, “বিগত ৭২ ঘণ্টায় তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সফর ও তাদের বক্তব্য থেকে ৫টি বিষয় স্পষ্ট, যা বাংলাদেশের জন্য জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো, অবকাঠামো ঠিক করা, দুর্নীতি দূর করা, আর্থ সামজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো, সংঘাত থেকে বের হয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জোরদার করা।
এছাড়া বাজেট বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে উদ্যোগে নিতে হবে বলে মত দেন দেবপ্রিয়।
দেবপ্রিয় অভিমত দেন, “ বিনিয়োগকে এগিয়ে নিতে হলে সম্প্রসারণমূলক বাজেট দিতে হবে। তবে তা দিতে হবে সাবধানতার সঙ্গে, যাতে তা মূল্যস্ফীতি না বাড়ায় এবং ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত না করে।“
বিদুৎ ও জ্বালানি খাতের বিষয়ে তিনি বলেন, “ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন জরুরি ছিলো। কিন্তু এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করা হয়নি। সময় মতো বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। চাপ পড়েছে পুরো অর্থনীতির ওপর। এটা এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ প্রশাসনিক ও সরকারের ব্যর্থতা।“
এ সময় অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের বৈদেশিক সাহায্য-ছাড়ের দিকে নজর দিতে হবে। এটা সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।“
এদিকে সিপিডির পক্ষে বাজেট প্রস্তাবনায় সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক কাঠামো, আর্থিক পদক্ষেপ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং বাজেট বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
ড. ফাহমিদা বলেন, “শোনা যাচ্ছে ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছে। এটা টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য হবে। তবে বিদেশি সাহায্যের ছাড় বাড়াতে হবে।“
ব্যক্তিখাতে করদাতাদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ টাকা করা যেতে পারে, নারীদের ক্ষেত্রে তা ২ লাখ ২০ হাজার এবং প্রতিবন্ধীদের ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা যেতে পারে।“
সিপিডি বলছে, কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এর জন্য গবেষণা দরকার, যাতে ভর্তুকির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা জানা যায়।
ড.ফাহমিদা বলেন, “তৈরি পোশাক শিল্পে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।“
সামাজিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গে সিপিডির মত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। তবে অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, একই ব্যক্তি নানা খাতের সুবিধা পাচ্ছেন। এটা যাতে না হয়।
ড.ফাহমিদা বলেন, “পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য আমরা সব সময় পরামর্শ দিয়ে আসছি। এর বিও হিসাবধারীদের সকলকে ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) থাকতে হবে। এবারের বাজেটে এটি করতেই হবে।“